শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান আলোচনা করো | Savitribai Phule’s contribution to education and social reform (Class 11 Exclusive Answer)

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান – সাবিত্রীবাঈ ফুলে ছিলেন একজন খ্যাতনামা সমাজসংস্কারক, কবি, শিক্ষিকা এবং ভারতীয় সমাজ সেবিকা। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষের অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনকালে মহিলাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁর আন্দোলন ছিল তৎকালীন ভারতবর্ষে প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় গোত্র ও লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে। তিনি পীড়িত সমাজের উন্নতির জন্য আজীবন প্রয়াস চালিয়ে গেছেন।

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান

শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান আলোচনা করো
শিক্ষা ও সমাজসংস্কারে সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান আলোচনা করো

সাবিত্রীবাঈ ফুলের সংক্ষিপ্ত জীবনী

সাবিত্রীবাঈ ফুলের পুরোনাম হল সাবিত্রীবাঈ জ্যোতিরাও ফুলে। তিনি পরাধীন ভারতবর্ষে 1831 খ্রিস্টাব্দের ও জানুয়ারি বোম্বে প্রেসিডেন্সির নাই গাঁওতে (বর্তমান সাঁতার অঞ্চলে) এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ছিল খন্ডোজি নেভাসে পাটিল এবং তাঁর মাতার নাম ছিল লক্ষ্মী পাটিল। সাবিত্রীবাঈ ফুলে যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন সমাজব্যবস্থা এমন পর্যায়ে ছিল যে, মেয়েদের শিক্ষা তখন অপরিহার্য ছিল না। বিবাহের পর সাবিত্রীবাঈ ফুলে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর তিনি প্রথাগত বিদ্যালয়ের পরিবর্তে তাঁর বাড়ির নিকটবর্তী পাঠশালাতে শিক্ষা লাভ করেন। বাড়িতে পড়াশোনা করে মাধ্যমিক স্তরের পঠন-পাঠনের জ্ঞান লাভ করেন।

পরবর্তীকালে তাঁর স্বামী জ্যোতিরাও ফুলে 1848 খ্রিস্টাব্দে মেয়েদের পঠন পাঠনের জন্য একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলে, তিনি সেই বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। শিক্ষাদানের পাশাপাশি সমাজ সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত থাকেন এবং সাহিত্য রচনার ব্রতী হন। সমাজসেবা ছিল সাবিত্রীবাঈ-এর অন্যতম প্রধান কাজ। 1897 খ্রিস্টাব্দে প্লেগ রোগ মহামারি আকার ধারণ করলে, প্লেগ রোগীদের চিকিৎসার জন্য নালাসোপারাতে সাবিত্রীবাঈ ও তাঁর পুত্র যশোবন্ড একটি চিকিৎসালয় ও সেবাকেন্দ্র স্থাপন করেন। প্লেগ রোগীদের পরিচর্যাকালে তাঁর দেহে রোগের জীবাণুর সংক্রমণ ঘটে এবং তিনি বিউবনিক প্লেগরোগের প্রকোপে 66 বছর বয়সে 1897 খ্রিস্টাব্দের 10 মার্চ মহারাষ্ট্রের পুনেতে মৃত্যু বরণ করেন।

সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদান

সাবিত্রীবাঈ ফুলের অবদানকে মূলত তিনটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। এই ভাগগুলি হল- শিক্ষার প্রসার, সমাজসংস্কার এবং  মানবসেবা।

(1) শিক্ষার প্রসার: 

সাবিত্রীবাঈ ফুলে তাঁর স্বামীর অনুপ্রেরণাতে পঠনপাঠনে আগ্রহী হন এবং পড়াশোনা করতে করতে উপলবন্ধি করেন, তাঁর সময়ে নারী শিক্ষার প্রথা প্রচলিত ছিল না, তিনি ভেবে দেখেছিলেন, তৎকালীন সমাজ ব্যসস্থায় অর্ধেকটা অংশ জুড়ে থাকে পুরুষ আর অর্ধেকটা অংশ জুড়ে থাকে নারী। ফলে নারীরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হলে পুরো সমাজের অর্ধেকটা অংশই অন্ধকারে থেকে যাবে। ফলে সমাজের অগ্রগতি পদে পদে বাধাপ্রাপ্ত হবে। তাই তিনি তাঁর স্বামীর সাথে এবিষয়ে পরামর্শ করে যুগ্মভাবে 1৪টি বিদ্যালয় স্থাপন করেন। সেই সময় তীব্র জাতিভেদ প্রথা সমাজের একটি কুসংস্কার হিসেবে পুরো সমাজের উন্নয়নকে আটকে রেখেছিল। তিনি তাঁদের তৈরি বিদ্যালয়ে বিভিন্ন গোত্রের শিশুদেরকে একসাথে পড়ানোর অর্থাৎ শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেন। এইভাবে তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন শিক্ষার প্রসারে কাজ করে গেছেন।

(2) সমাজসংস্কার: 

[i] সাবিত্রীবাঈ ফুলে ‘নারীদের শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা উচিত’-এবিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার শুরু করেন। এর জন্য তিনি বিভিন্ন স্থানে সেমিনার বা আলোচনা চক্রের আয়োজন করেন। গ্রামবাসীদের বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে তাদের সামনে মহিলাদের শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কতখানি তা ব্যাখ্যা করেন। [ii] সমাজে কন্যা সন্তান অবহেলার পাত্রী নয়। পুরুষদের মতো মহিলারা যাতে সমান অধিকার ও সুযোগ পায় সে বিষয়ে তিনি জনমত গঠনে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করেন। [iii] সমাজের বিভিন্ন প্রকার অসহিহ্বতার বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি সমাজের যাবতীয় অসহিদ্ভুতা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যান।

[iv] তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষজনের সাংস্কৃতিক মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য এবং সামাজিক অগ্রগতির জন্য সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তিনি পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য শুধু আলোচনাচক্র বা সচেতনতা দানেই ক্ষান্ত থাকেননি, বরং তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। [v] তিনি জাতিভেদ প্রথা নির্মূল করতে এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা ও প্রচারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। তিনি পিছিয়ে পড়া তথা প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অধিকার ও মর্যাদার পক্ষে; অস্পৃশ্যতা, বর্ণভিত্তিক বৈষম্য এবং সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

[vi] শিক্ষা সংস্কারে সাবিত্রীবাঈ-এর কাজ কেবল মেয়েদের শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং তিনি জাতি, ধর্ম ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজের আপামর জনগণের জন্য শিক্ষার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। [vii] সাবিত্রীবাঈ এবং তাঁর স্বামী জ্যোতিবা ফুলে একসাথে সমাজে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং অস্পৃশ্যতা দূরীকরণের জন্য কাজ করেছেন।

(3) মানবসেবা: 

[i] সাবিত্রীবাঈ ফুলে তাঁর স্বামীর সাথে যুগ্মভাবে ধর্ষিতা নারী এবং তাদের সন্তানদের সাহায্যের জন্য একটি পরিষেবা কেন্দ্র স্থাপন করেন। সেই পরিবষেবা কেন্দ্র থেকে ধর্ষিতাদের সবধরনের সাহায্য প্রদান করা হয়। [ii] সাবিত্রীবাঈ ও তাঁর পুত্র যশোবন্ত 1897 খ্রিস্টাব্দে প্লেগরোগীদের চিকিৎসা প্রদানের সময় সাবিত্রীবাঈ-এর শরীরে প্লেগের জীবাণু প্রবেশ করে। তিনি সেখানে আক্রান্ত হন এবং এক সময় মৃত্যুবরণ করেন। 

(4) নারীশিক্ষার প্রসার: 

সাবিত্রীবাঈ ফুলে 1848 খ্রিস্টাব্দে ভারতে প্রথম মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা তখনকার সময়ে অত্যন্ত বিপ্লবী পদক্ষেপ ছিল। এই স্কুলের মাধ্যমে তিনি নারীশিক্ষার গুরুত্ব প্রচার করেন।

(5) বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ: 

সাবিত্রীবাঈ ফুলে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করেছিলেন এবং এই প্রথা রোধে কাজ করেছিলেন।

(6) বিধবা ও অবহেলিত নারীদের জন্য আশ্রয়দান: 

সাবিত্রীবাঈ ফুলে বিধবা ও অবহেলিত নারীদের জন্য আশ্রয় এবং শিক্ষার সুযোগ প্রদান করেছিলেন, যা তাদের আত্মনির্ভরশীল হতে সহায়ক ছিল।

(7) মহিলা আয়ন সংস্থা প্রতিষ্ঠা: 

সাবিত্রীবাঈ ফুলে মহিলা সেবামণ্ডল স্থাপন করেন, যা নারীদের ক্ষমতায়ন ও তাদের অধিকারের পক্ষে কাজ করে।

সাহিত্যিক হিসেবে অবদান

উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে সমাজসংস্কার ও শিক্ষা উন্নয়নে সাবিত্রীবাঈ ফুলের সাহিত্যগত অবদান প্রশংসার দাবি রাখে। তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধগুলি জনমত গঠন করতে, নিপীড়নমূলক নিয়মনীতিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে এবং প্রান্তিক ও পশ্চাৎপদ সম্প্রদায়ের মহিলাদের পক্ষে ওকালতি করার জন্য শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল।

  1. তিনি তাঁর কবিতা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে অজ্ঞতা ও বৈষম্যের শৃঙ্খল ভাঙতে সমর্থ হয়েছিলেন এবং সামাজিক অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছিলেন।
  2. তিনি তাঁর রচিত কবিতা ও প্রবন্ধে লিঙ্গসমতার পক্ষে জোরালোভাবে সওয়াল করেছেন এবং সেই পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন যেই কাঠামো নারীকে অধস্তন ভূমিকায় অবনমিত করে রেখেছে।
  3. সেই যুগের সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর লেখাগুলি বিভিন্ন নারী সংস্থা, স্বায়ত্ব শাসনমূলক পরিকাঠামো ও সামাজিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করেছিল, যা ভারতে প্রাথমিক নারীবাদী চিন্তন হিসেবে আজও সমাদৃত হয়।
  4. কবি, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক হিসেবে সাবিত্রীবাঈ ফুলে তাঁর রচিত সাহিত্যকে সমাজসংস্কার ও চেতনা জাগরণের মঞ্চ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। তাঁর সৃষ্টিগুলি শিক্ষা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নারীর অধিকারকে এমনভাবে তুলে ধরেছিল যে, পরবর্তীকালে বহু সমাজকর্মী ও বুদ্ধিজীবী সেগুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।
  5. সাবিত্রীবাঈ-এর সাহিত্যিক ক্রিয়াকলাপ দলিত অধিকার আন্দোলন, মহিলাদের ক্ষমতায়নের উদ্যোগ এবং শিক্ষা বিষয়ক সংস্কার আন্দোলনের গতিপথকে এমনভাবে আলোকিত করেছিল যে, পরবর্তী পর্যায়ে তার প্রভাব অন্তর্ভুক্তিমূলক শিখনে ও ন্যায়সংগত সমাজ গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে চলেছে।

সাবিত্রীবাঈ-এর কার্যাবলির মূল্যায়ন

উনিশ শতকের ভারতে নারী শিক্ষার প্রসার, সমাজসংস্কার, সেবাকর্ম এবং শিক্ষার মনোন্নয়নের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কার্যাবলি সাবিত্রীবাঈকে একজন স্মরণীয়, বরণীয়, সমাজসংস্কারক হিসেবে আপামর জনগণের কাছে তুলে ধরেছে এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

  1. সমাজসেবার ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য পুনে সিটি কর্পোরেশন সাবিত্রীবাঈ ফুলের স্মৃতির উদ্দেশ্যে 1983 খ্রিস্টাব্দে একটি স্মারক স্থাপন করেন। ভারতীয় ডাকবিভাগ তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে 1998 খ্রিস্টাব্দে একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করেন। পুনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ 2015 খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পালটে ‘সাবিত্রীবাঈ ফুলে বিশ্ববিদ্যালয়’ রাখেন।
  2. সাবিত্রীবাঈ-এর কার্যাবলি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আঙিনা ছাড়িয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে প্রসারিত হয়েছিল। তিনি ভারতীয় সমাজে প্রচলিত বর্ণবৈষম্য, অস্পৃশ্যতা এবং অন্যান্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
  3. সাবিত্রীবাঈ-এর লেখনীর গুণে বাল্যবিবাহ, পর্দাপ্রথা এবং ভারতীয় সমাজে মহিলাদের সুযোগের অভাবের মতো বিষয়গুলি জনগণের মধ্যে অনেকখানি সচেতনতা জাগ্রত করেছিল।
  4. সাবিত্রীবাঈ-এর সাহিত্যকর্ম সামাজিক সংস্কারের পক্ষে যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে, তার প্রভাবে আজও বহু মানুষ ক্ষমতা ও ন্যায়বিচারের আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যায়।

উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলা যায় যে, সাবিত্রীবাঈ-এর সমাজসেবা ও সমাজসংস্কারমূলক কার্যাবলির প্রভাব আজও বিভিন্ন সমাজকর্মীকে, শিক্ষাবিদকে এবং নারীবাদীদেরকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তার অগ্রণী কার্যাবলি নারী অধিকার, সবার জন্য শিক্ষা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্দীপনা জোগায়। তিনি ভারতের ইতিহাসে একজন প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব হিসেবে রয়ে গেছেন।

আরও পড়ুনLink
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১Click Here
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২Click Here
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment