উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম – মাধ্যমিক শিক্ষার শেষভাগ হল উচ্চমাধ্যমিক । কোঠারি কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী 2 বছরের এই স্তর একাদশ এবং দ্বাদশ এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। এই শিক্ষাস্তরের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত বয়স হল 17+ বছর। কোঠারি কমিশন প্রস্তাবিত এই স্তরের (+2 স্তর) পাঠক্রমে দুটি প্রবাহ সাধারণ এবং বৃত্তিমূলক। সাধারণ শিক্ষা তত্ত্বমূলক, যা উত্তীর্ণ হওয়ার পরে শিক্ষার্থীরা সাধারণ উচ্চশিক্ষায় (বিএ, বিএসি, বিকম) প্রবেশ করে বা পেশাগত শিক্ষায় (ইঞ্জিনিয়ারিং, চিকিৎসাবিদ্যা ইত্যাদি) প্রবেশ করে। আর বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সরাসরি পেশাগত জীবনে বা উচ্চতর পেশাগত শিক্ষার জগতে প্রবেশ করে।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম

উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রমকে সাধারণ ও বৃত্তিমূলক এই দু-ভাগে বিভক্ত করা হয়।
(1) সাধারণ শিক্ষার পাঠক্রম:
পশ্চিমবঙ্গে এই পাঠক্রমে চারটি ভাগ দেখা যায়-
- ভাষা: এই স্তরে দুটি ভাষা বাধ্যতামূলক। এই দুটি ভাষা হল নিম্নমাধ্যমিক স্তরের তিনটি ভাষার মধ্যে যে-কোনো দুটি ভাষা; অথবা, আধুনিক ভারতীয় ভাষা, আধুনিক বিদেশি ভাষা ও প্রাচীন ভারতীয় ভাষা-এই তিনটির মধ্যে যে-কোনো দুটি ভাষা।
- আবশ্যিক ঐচ্ছিক বিষয়: পরীক্ষাগারভিত্তিক এবং পরীক্ষাগারভিত্তিক নয় এমন মোট 21টি বিষয় থেকে তিনটি বিষয়।
- অতিরিক্ত বিষয়: ওপরে উল্লিখিত আবশ্যিকভাবে তিনটি বিষয় ছাড়াও শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে একটি বিষয় নির্বাচন করার সুযোগ পায়, তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।
- কর্মভিত্তিক বিষয়: কর্মশিক্ষা, শারীরশিক্ষা এবং সমাজসেবার মধ্যে যে-কোনো একটিকে বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হয়। বর্তমানে কম্পিউটার শিক্ষাও কর্মভিত্তিক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
(2) বৃত্তিমূলক শিক্ষার পাঠক্রম:
এক্ষেত্রে পাঠক্রমের বিষয়গুলিকে চারটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে-
- ভাষা: সাধারণ পাঠক্রমের মতো এক্ষেত্রেও দুটি ভাষা বাধ্যতামূলক।
- আবশ্যিক ঐচ্ছিক বিষয়: সাধারণ শিক্ষার মতো তিনটি বিষয়কে নির্বাচন করতে হয়।
- বৃত্তিমূলক বিষয়: পাঁচটি বিষয়ের (কৃষিবিজ্ঞান, বয়নশিল্প, কারিগরিবিদ্যা, ব্যাবসাবাণিজ্য এবং প্যারামেডিকেল) মধ্যে যে-কোনো একটি বিষয়কে নিতে হবে।
- কর্মভিত্তিক বিষয়: এই স্তরটি সাধারণ শিক্ষার মতো।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা
একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রম উচ্চমাধ্যমিক বা ‘+2’ নামে পরিচিত। পশ্চিমবঙ্গে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা লক্ষ করা যায়। এগুলির মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হল-
(1) বিদ্যালয়ের সমস্যা:
পশ্চিমবঙ্গে কলেজ ও বিদ্যালয় উভয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাদান করা হত। বর্তমানে কলেজে ত্রিবার্ষিক স্নাতক পাঠক্রম চালু হওয়ায় কলেজ থেকে এই শিক্ষাক্রম তুলে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে পরিকাঠামোর অভাবে বহু বিদ্যালয়েই এই পাঠক্রম চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে বিদ্যালয়ের সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করেছে।
(2) উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব:
অধিকাংশ বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর জন্য উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন বিশেষ করে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষকশিক্ষিকার অভাব রয়েছে।
(3) পরীক্ষাগার ও গ্রন্থাগারের অভাব:
অনেক বিদ্যালয়েই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিজ্ঞান পড়ানোর জন্য পরীক্ষাগারের অভাব রয়েছে। এ ছাড়া বহু বিদ্যালয়ে উপযুক্ত গ্রন্থাগার নেই। আবার অনেক গ্রন্থাগারে উপযুক্ত পরিমাণে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক এবং তথ্যপুস্তকের অভাব রয়েছে।
(4) পাঠক্রমের ত্রুটি:
উচ্চমাধ্যমিক পাঠক্রমটি এতই বিশাল যে সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণদের পক্ষে তা আয়ত্ত করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ ছাড়া মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রমকে ঠিকমতো যুক্ত করাও হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেকেই উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিফল হয়। উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন বিষয়ের পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিষয়গুলির বিস্তৃতি বেশি হলেও গভীরতা কম। আবার পাঠ্যসূচি অনেক ক্ষেত্রেই সময়োপযোগী নয়।
(5) বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রসারের অপ্রতুলতা:
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা খুবই কম। তাই ইচ্ছা থাকলেও বহু ছাত্রছাত্রী বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
(6) সময়ের অভাব:
উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমের জন্য দুই বছর অর্থাৎ চব্বিশ মাস ধার্য করা হলেও, বাস্তবে ছাত্রছাত্রীরা কুড়ি মাস মতো সময় পায়। সময়ের অভাবে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কেউই পাঠক্রম শেষ করতে পারে না।
(7) পরীক্ষার সমস্যা:
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে পরীক্ষার সমস্যা অত্যন্ত প্রকট, বিশেষ করে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে। উপযুক্ত সংখ্যক যোগ্য পরীক্ষকের অভাব এর অন্যতম কারণ।
(8) অন্যান্য সমস্যা:
এই সমস্যাগুলি ছাড়াও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার ক্ষেত্রে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সমস্যা, ত্রুটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা, প্রাইভেট কোচিং নামক সমান্তরাল শিক্ষাব্যবস্থা প্রভৃতি নানাধরনের সমস্যা রয়েছে।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা সমাধানের উপায়
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় তার সমাধানের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত।
(1) পরিকাঠামোর উন্নতি:
বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর উন্নতি করতে হবে। যেমন-আরও শ্রেণিকক্ষ, সমৃদ্ধ লাইব্রেরি, রিডিং রুম এবং পরীক্ষাগারের আধুনিকীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
(2) অধিক সংখ্যক বিদ্যালয় স্থাপন:
আরও বেশি বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
(3) যোগ্যতাসম্পন্ন ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ:
উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক বেশি করে নিয়োগ করতে হবে।
(4) পাঠক্রমের আধুনিকীকরণ:
পাঠক্রমের আধুনিকীকরণ করতে হবে।
(5) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষাকে উন্নত করা:
মাধ্যমিক এবং স্নাতক স্তরের সঙ্গে উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রম যাতে আরও বেশি করে সম্পর্কযুক্ত হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
(6) পরীক্ষাব্যবস্থার সংস্কার:
পরীক্ষাব্যবস্থায় সংস্কার আনতে হবে।
(7) প্রশাসনিক ব্যবস্থার উন্নতিকরণ:
প্রশাসনিক সমস্যার সমাধান করে বিদ্যালয়কে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে।
(8) বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার:
উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আরও বেশি সংখ্যক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগ খোলার জন্য উৎসাহ দিতে হবে।
উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাক্রমের সমস্যাগুলি শনাক্ত করে সমাধানের ব্যবস্থা করলে শিক্ষাক্রমটি ছাত্রছাত্রীদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এবং আরও বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে উচ্চশিক্ষা অভিমুখী করে তোলা যাবে।
উচ্চশিক্ষা এবং জীবনব্যাপী শিক্ষা
প্রাপ্তবয়সের প্রথম দিকে ব্যক্তি প্রথাগত সাধারণ শিক্ষা বা পেশাগত শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। পরে বৃত্তিগ্রহণ করে গার্হস্থ্য জীবনে প্রবেশ করে। তবে দূর-শিক্ষাব্যবস্থা চালু হবার ফলে গার্হস্থ্য জীবনের পাশাপাশি অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি তাদের আগ্রহ অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ের ওপর জ্ঞানার্জনে মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছেন। এ ছাড়া অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি বৃত্তিতে উন্নতির জন্য বৃত্তিকালীন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
আরও পড়ুন | Link |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১ | Click Here |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২ | Click Here |
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |