জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস

Table of Contents

জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর | ক্লাস 12 চতুর্থ সেমিস্টার ইতিহাস | HS 4th Semester History Long Question answer 7th Chapter

জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর
জাতিগঠন ও সম্পর্কিত দিকসমূহ (সপ্তম অধ্যায়) প্রশ্ন উত্তর

১। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণ আলোচনা করো।
অথবা, স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের কারণগুলি লেখো।

ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তের দুটি ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান রাষ্ট্র। ধর্ম ইসলাম হলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট ব্যবধান ছিল। এ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক কারণ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে উপজাতীয়তাবাদী ধারণা বিকাশে সহায়তা করে। যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। এর ফলস্বরূপ ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কারণ/স্বাধীন বাংলাদেশের উত্থানের কারণ:

পাকিস্তান গঠনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান লক্ষ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে আধা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রে পরিণত করা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে তারা মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন।

(i) রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বঞ্চনা: ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সংবিধান রচিত হলেও প্রতিনিধিত্বের আনুপাতিক হার সঠিক ছিল না। এ ছাড়া সারাদেশে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ সরকারি পদগুলি পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষদের মধ্যে কুক্ষিগত ছিল। ফলে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত শ্রেণি উচ্চ সরকারি পদলাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন।

(ii) অর্থনৈতিক বৈষম্য: পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পশ্চিম ও পূর্ব-দুই অঞ্চলের উন্নয়নের সম্ভাবনা প্রায় সমান হলেও পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ পোষণ করেন। পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপন হলেও পূর্ব পাকিস্তানে তা হয়নি। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত খাদ্যসম্পদ বাধ্যতামূলকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে থাকে, যা এই অঞ্চলের অধিবাসীদের হতাশ করেছিল।

(iii) ভাষা আন্দোলনের প্রভাব: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে না কি বাংলা এই বিষয়কে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ শুরু করেন ভাষা আন্দোলন। এই ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ঐক্যভাব জাগ্রত করেছিল, বিকাশ ঘটিয়েছিল স্বতন্ত্র চেতনার। ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিবাদে তারা একত্রিত হয়।

(iv) স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও তা অপূরণে অনীহা: পশ্চিম পাকিস্তানের একপেশে নীতি ও সুবিধা প্রদানে অনীহা বাংলাভাষী সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের জনমানসে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়। অতঃপর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, যা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে জোড়ালো করে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখলে তা আর সম্ভব হয়নি।

(v) পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষোভ ও অপারেশন সার্চলাইট: জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘটনায় ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালন করেন। ২ মার্চ রাতে কারফিউ জারি করা হলে ছাত্র-সহ শ্রমিক, কৃষকেরা স্লোগান দেয়- ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’ ৩ মার্চ আবার পল্টনে আয়োজিত এক জনসমাবেশে পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইস্তাহার। ওই দিন থেকে পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ১৫ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের আলাপ-আলোচনাও ব্যর্থ হয়। কারণ আওয়ামী লীগ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে অনড় থাকে। অতঃপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট চালু করে এবং এর মাধ্যমে নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর প্রায় ২৬৭ দিন ধরে হত্যালীলা চালানো হয়।

(vi) মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা : এরূপ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টেলিপ্রিন্টার মারফৎ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিনি বলেন- “আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। এই আমার শেষ কথা….. জয় বাংলা।” ১৭এপ্রিল তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীসভা শপথ নেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী পদে বসেন তাজউদ্দিন আহমেদ। বৈদ্যনাথতলার নতুন নাম দেওয়া হয় মুজিবনগর। এসময় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ ঘোষণা করেছিলেন যে, অস্থায়ী রাজধানী মুজিবনগর থেকেই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হবে।

২। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত কেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করে?
অথবা, ভারত কেন ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করেছিল?

ভারত নীতিগতভাবে অন্য কোনও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরোধী। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঘটনা নানাভাবে এদেশের নিরাপত্তা ও স্থিতাবস্থাকে বিঘ্নিত করে। তাই ভারত এই অস্থিরতার সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ডারতের হস্তক্ষেপের কারণ:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপের কারণগুলি হল-

(i) সীমান্তের নিরাপত্তা: ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে সাবেক বাংলাকে খণ্ডিত করে পূর্ব পাকিস্তান গঠন করা হয়। ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের একটা বড়ো অংশই ছিল সমতলভূমি। আবার কিছু অংশে আছে নদী। পূর্ব পাকিস্তানের অশান্তি এবং পাক-সেনাবাহিনী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ দমনের চেষ্টা ভারতের সীমান্তের নিরাপত্তা ক্ষুন্ন করে। কাজেই সীমান্তের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য তৎপরতার সঙ্গে ভারতকে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়।

(ii) মানবিক দায়িত্ববোধ: মুক্তিযোদ্ধাদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্মম দমনপীড়নের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সশস্ত্র বাহিনীর অত্যাচার, নারীনির্যাতন, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা ইত্যাদি সেখানকার সাধারণ মানুষকে প্রাণভয়ে দেশছাড়া হতে বাধ্য করে। ফলে দলে দলে সর্বহারা মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। জানা যায় যে, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসের মধ্যেই প্রায় ৩৪ লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীরূপে এসেছিলেন। অসংখ্য নারী, পুরুষ, শিশুর আর্তনাদ ভারতকে মানবিকতার তাগিদে এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য করেছিল।

(iii) অর্থনৈতিক চাপ: মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কয়েক লক্ষ মানুষ পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। মানবিকতা তথা নৈতিক কর্তব্যবোধের তাগিদে ভারত সেই অসহায় নারী, শিশু-সহ অসংখ্য পাক-জনতাকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হয়। তাদের ভরণপোষণের খাতে ভারতের বিপুল অর্থ ব্যয় হতে থাকে। স্বভাবতই পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার আশু সমাধান ভারতের কাছে নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়।

(iv) অভ্যন্তরীণ সংহতি রক্ষার দায়বদ্ধতা : বাংলাদেশে গণযুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে ভারতের উপর তার অশুভপ্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ছিল। বাংলাদেশের জনযুদ্ধের দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম প্রভৃতি অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির নতুন উদ্যমে আন্দোলনে নামার সম্ভাবনা ছিল। তাই ভারত দ্রুত বাংলাদেশ যুদ্ধের সমাপ্তি কামনা করে।

(v) অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ: স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নটি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রবল আধিপত্যকারী উপাদানে পরিণত হয়। সরকারি দল কংগ্রেস ছাড়া অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্যদানের পক্ষে মত প্রকাশ করে।

জাতীয় কংগ্রেসও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিল না। তবে সরকারে থাকার কারণে তাদের অন্য দায়বদ্ধতা ছিল। তবে কংগ্রেস জানায় যে, উপযুক্ত সময়ে সরকার সঠিক ব্যবস্থা নেবে। ৩১ মার্চ জাতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধি উত্থাপিত রেজলিউশনে বলা হয়, “আমাদের সীমান্তের এত নিকটে যে নিষ্ঠুর বর্বরতা চলছে, সে বিষয়ে এই সংসদ উদাসীন থাকতে পারে না।”

এই সকল কারণগুলি বিচারবিশ্লেষণ করে বলা যায় যে, আলোচ্য পর্বে সংকটাপন্ন বাংলাদেশকে সহায়তা করা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির কাছে কেবল নৈতিক কর্তব্য নয়, রাজনৈতিক দায়িত্ব হয়ে উঠেছিল। আর এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভারত মুক্তিযুদ্ধরত পূর্ব পাকিস্তানের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।

৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের ভূমিকা লেখো।
অথবা, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান আলোচনা করো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ভারত মানবিক, নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে এবং নিজের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে/মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা:

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত মানবিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক-সকল দিক থেকেই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

(i) প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের একেবারে শেষের দিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি সংসদে প্রস্তাব রাখেন যে, ‘ভারতের জনগণ পূর্ব বাংলার পাশে আছে। ওদের (পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধা) আত্মবিসর্জন বৃথা হবে না, ভারতবর্ষের সর্বান্তঃকরণ সহানুভূতি এবং সহায়তা ওরা পাবেন।’ এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সংসদে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব সংসদের উভয় সভাতেই (লোকসভা ও রাজ্যসভা) বিনা আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।

(ii) মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণদান: মুক্তিকামী বাংলাদেশের যোদ্ধারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালালেও তাদের পর্যাপ্ত অস্ত্রশস্ত্র ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এপ্রিল মাস থেকে ভারতের বি এস এফ বাহিনী (Border Security Force) বিক্ষিপ্তভাবে তাঁদের প্রশিক্ষণদান, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাহায্য করছিল। তবে মে মাসের শেষের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এই দায়িত্ব বি এস এফ-এর থেকে গ্রহণ করলে তা আরও সুসংবদ্ধ রূপ পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, দেরাদুনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হত।

(iii) মুজিব বাহিনী গঠন: এই সময় ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবিত একদল তরুণ ও যুবকদের নিয়ে মুজিব বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বাহিনী কোনও কমান্ডের অধীনে না থেকে স্বতন্ত্রভাবে নিজস্ব নির্দেশ মান্য করত।

(iv) শরণার্থীদের আশ্রয়দান: মুক্তিযুদ্ধের পর্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের আশ্রয়দান ভারত সরকারের সহযোগিতার অপর এক অধ্যায়। পরিসংখ্যান মতে, ৭১-এর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রত্যেকদিন গড়ে ২০,০০০-৪৫,০০০ ভীত, সন্ত্রস্ত শরণার্থী এদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রায় সব ধর্মেরই মানুষ ছিলেন। এই বিপুল সংখ্যক (প্রায় ১ কোটি) শরণার্থীর ভার বহনের জন্য ভারতকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। শুধু বাস্তুহারাদের আশ্রয়দানই নয়, তাদের খাদ্য, চিকিৎসা, গৃহনির্মাণেও ভারত অকাতরে অর্থ ব্যয় করেছিল।

(v) মুজিবুর রহমানের বিচারকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ আগস্ট পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার বন্দি বঙ্গবন্ধু মুজিব-এর বিচার করার কথা ঘোষণা করলে ভারত তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করে। শুধু তাই নয়, ৪ আগস্ট ভারতীয় সংসদের সদস্যরা মিলিতভাবে শেখ মুজিব-এর জীবনরক্ষার উদ্দেশ্যে যে-কোনো প্রচেষ্টা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানায়।

(vi) আন্তর্জাতিক স্তরে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা উত্থাপন: ভারত আন্তর্জাতিক স্তরে তথা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের অসহায় মানুষদের উপর পাক হানাদার বাহিনীর অন্যায় আক্রমণ, বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা সম্পর্কে প্রচার চালায়। এক্ষেত্রে ভারতীয় সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমগুলি বিশেষভাবে সক্রিয় ছিল।

(ii) প্রত্যক্ষ যুদ্ধে যোগদান ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান: ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় সেনারা যৌথভাবে একটি কমান্ড গঠন করেছিলেন। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী আকস্মিকভাবে ভারতের অমৃতসর, কাশ্মীর উপত্যকায় বোমাবর্ষণ করলে ভারত সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ৬ ডিসেম্বর রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দেয়।

ভারতের পদাতিক ও বিমানবাহিনীর যৌথ আক্রমণে পাকিস্তান বিদ্ধস্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর পাক-বাহিনীর প্রধান জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা-র কাছে আত্মসমর্পণ করেন। প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা ভারতের হাতে যুদ্ধবন্দি হন। যুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাব ঘটে। ১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশে বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়।

৪। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা আলোচনা করো।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তাঁর সাহসী মনোভাব, কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ও মুক্তিসংগ্রামকে অবিরাম সমর্থন দান স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশকে ত্বরান্বিত করেছিল।

বাংলাদেশের দুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা:

ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির দূরদর্শিতা ও মানবিকতায় একটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে সাফল্যমন্ডিত করেছিল।

(i) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্রকে রাজনৈতিক সমর্থন দানः ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে ইন্দিরা গান্ধি কর্তৃক উত্থাপিত রেজলিউশনে বলা হয়, “আমাদের সীমান্তের এত নিকটে যে নিষ্ঠুর বর্বরতা চলছে, সে বিষয়ে এই সংসদ উদাসীন থাকতে পারে না। পাশাপাশি তিনি এও ঘোষণা করেন যে, ভারত পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করবে।

(ii) কূটনৈতিক সাহায্যদান: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পরিস্থিতিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করেন। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গণহত্যা ও বিপুল সংখ্যক বাসস্থানত্যাগী পূর্ব পাকিস্তানবাসীর করুণ পরিণতির কথা জানাতে নানা দেশে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেছিলেন তিনি। এ ছাড়াও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইন্দিরা গান্ধি স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড-সহ পশ্চিমের ৮টি দেশে সফর করেন।

(iii) প্রত্যক্ষ যুদ্ধে ভারতের অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবহে পাকিস্তান বিমানবাহিনী আকস্মিকভাবে ভারতের পশ্চিম প্রান্তে অমৃতসর, কাশ্মীর উপত্যকায় বোমা বর্ষণ করে। এরূপ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধের নির্দেশ দেন।

ইন্দিরা গান্ধির সক্রিয় সমর্থনে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরিশেষে একথা বলা যায় যে, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম পথপ্রদর্শক।

আরো পড়ুন : উচ্চমাধ্যমিক ইতিহাস চতুর্থ সেমিস্টার সব অধ্যায়ের প্রশ্ন উত্তর

Leave a Comment