একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টার দর্শন বিষয়ে মোট 40 নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। এই 40 নম্বরের মধ্যে পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা অধ্যায় থেকে মোট 8 নম্বর আসবে। পাশ্চাত্য নীতিবিদ্যা অধ্যায়ের মধ্যে দুটি টপিক আছে। একটি হল নৈতিক প্রত্যয়সমূহ এবং আরেকটি নৈতিক তত্ত্বসমূহ। আজকের এই প্রশ্নোত্তর পর্বে একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিষ্টার দর্শন পরীক্ষার জন্য নৈতিক তত্ত্বসমূহ অধ্যায় থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রশ্ন উত্তরসহ তুলে ধরা হল।
নৈতিক তত্ত্বসমূহ প্রশ্ন ও উত্তর

নীতি উপযোগবাদ প্রসঙ্গে বার্কলের যুক্তি ব্যাখ্যা করো।
বার্কলের মতে কর্ম উপযোগবাদের তুলনায় নীতি উপযোগবাদ অধিকতর গ্রহণযোগ্য। কেন-না কর্ম উপযোগবাদের ক্ষেত্রে এমন কিছু সমস্যা আছে যা নীতি উপযোগবাদের ক্ষেত্রে নেই। কাজের ক্ষেত্রে যদি ‘আমাদের কী করতে হবে’ বা ‘কোল্টি করা উচিত’ তা ঠিক করতে হয় তবে সময়ের অপচয় হয়। তেমনি আবার কর্মকর্তার অজ্ঞানতা, অসতর্কতা, আবেগ ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই বার্কলে বলেন, প্রতিবার কাজের আগে ‘কোন্ কাজটি কারা উচিত’ তা বিবেচনা না করে এমন কর্মনীতি অনুসরণ করতে হবে যাতে সর্বাধিক লোকের সর্বাধিক কল্যাণ সাধিত হয়।
আদি নীতি উপযোগবাদ কী?
আদি নীতি উপযোগবাদ (Primitive Rule Utilitarianism) হল নীতি উপযোগবাদের একটি প্রকার। এই মতবাদ অনুসারে সঠিক নিয়ম তাকেই বলা হবে যা সর্বাধিক কল্যাণ বা মঙ্গল সাধন করতে পারে। যখন একটি নিয়মের উপযোগিতার কথা বলা হয় তখন সেই নিয়মটি যে সমস্ত কর্মকে অনুমোদন করে, তাদের দ্বারা উৎপন্ন উপযোগিতার সমষ্টিকে বোঝানো হয়। এই উপযোগবাদ অনুসারে কোনো এক পরিস্থিতিতে একটি কাজ যদি একজনের কাছে উচিত কর্তব্য হয় তাহলে অন্য ব্যক্তিদের কাছেও ঐ পরিস্থিতিতে কাজটি উচিত কর্তব্য বলে বিবেচিত হবে।
বাস্তব নীতি উপযোগবাদ কী?
নীত উপযোগবাদের একটি রূপ হল বাস্তব নীতি উপযোগবাদ (Actual Rule Utilitarianism)। এই প্রকার উপযোগবাদের মূল বক্তব্য হল- যে সমস্ত নৈতিক নিয়মকে সাধারণভাবে গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করা হয়, কোনো কাজ যদি সেই প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে করা হয় তবেই সেই কাজটি যথার্থ বা যথোচিত বলে বিবেচিত হয়। প্রচলিত নিয়ম অনুসরণ করে বাক্যটি না করা হলে তা যথোচিত কাজ বলে বিবেচিত হবে না। কারণ এখানে মনে করা হয় যে, প্রচলিত নিয়মগুলি পালন করলে সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক মঙ্গল বা কল্যাণ সাধিত হবে।
আদর্শ নীতি উপযোগবাদ কাকে বলে?
নীতি উপযোগবাদের একটি অন্যতম প্রকার হল আদর্শ নীতি উপযোগবাদ (Ideal Rule Utilitarianism)। এই মতবাদ অনুসারে, সমাজের আদর্শমূলক নীতিগুলি নির্ধারণ করার পর সেগুলিকে গ্রহণ করতে হয় অথবা সেগুলির সাথে সংগতি বিধান করতে হয়। এই সকল আদর্শমূলক নীতিগুলিকে গ্রহণ করা বা সংগতি রক্ষা দ্বারা যদি কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ কর্ম করা হয়, তবে সেই কর্মগুলিকে নৈতিক কর্ম বলা হয়। আর যদি আদর্শমূলক নিয়মগুলিকে গ্রহণ না করে কর্ম সম্পাদন করা হয়, তবে কর্মগুলিকে অনৈতিক কর্ম বলা হয়।
নৈতিক আত্মসুখবাদ ও উপযোগবাদের মধ্যে পার্থক্য কী?
নৈতিক আত্মসুখবাদ অনুসারে কাজের নৈতিক মূল্য নির্ভর করে কর্মকতার নিজের কল্যাণ বৃদ্ধি করার উপর। অর্থাৎ এই মতবাদ আত্মকল্যাণ বৃদ্ধিকে প্রাধান্য দেয়, কিন্তু অন্য ব্যক্তিদের প্রতি উদাসীন থাকে। অপরপক্ষে, উপযোগবাদ যেমন আত্মকল্যাণ বৃদ্ধির উপর গুরুত্ব দেয়, তেমনি পরসুখ বৃদ্ধির কথাও উল্লেখ করে।
Deontology’ শব্দটির অর্থ কী?
‘Deontology’ – ইংরেজি শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘কর্তব্যবাদ’। ‘Deontology’ -শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Deon’ থেকে এসেছে, যার অর্থ হল কর্তব্য। সুতরাং ‘Deontology’ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হল- কর্তব্য সম্পর্কিত মতবাদ। আদর্শনিষ্ঠ নীতিবিজ্ঞানে ‘কর্তব্যবাদ’ বা ‘Deontology’ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ নৈতিক মতবাদ।
কর্তব্যবাদীদের মতে, একটি কর্ম বা কর্মনীতি কখন ‘ঠিক’ বা ‘যথোচিত’ বলে গণ্য হয়? অথবা, কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদ বলতে কী বোঝো? অথবা, ফলাফলনিরপেক্ষ তত্ত্ব কী?
কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদ অনুসারে কোনো কর্ম বা কর্মনীতিকে ঠিক বা যথোচিত বলা হবে যদি এবং কেবল যদি ওই কর্ম বা কর্মনীতি স্বতঃমূল্যবান হয়। অর্থাৎ কোনো কর্ম বা কর্মনীতি তার নিজ বৈশিষ্ট্যের জন্যই সৎ বা ভালো। উচ্চতর কোনো ফলাফলের উপায়রূপে সৎ বা ভালো নয়।
কর্তব্যবাদ কয় প্রকার ও কী কী?.
নীতিবিদ্যায় উদ্দেশ্যমুখী বা ফলমুখী তত্ত্বের বিপরীত একটি মতবাদ হল ফলাফলনিরপেক্ষ তত্ত্ব বা কর্তব্যবাদ। কর্ম ও নিয়মের ভূমিকার উপর নির্ভর করে কর্তব্যমুখী নৈতিক মতবাদের প্রধানত দুটি প্রকার দেখতে পাওয়া যায়। কর্ম কর্তব্যবাদ বা কর্মসম্বন্ধী ফলাফলনিরপেক্ষবাদ এবং নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদ বা নিয়মসম্বন্ধী ফলাফলনিরপেক্ষবাদ।
কর্ম কর্তব্যবাদ কী?
যে নীতি বা মানদণ্ড অনুসারে মানুষের কোনো কর্মের ন্যায় অন্যায়ের বিচার ওই কর্মের বৈশিষ্ট্য বা বিশেষ পরিস্থিতিতে সম্পাদিত কর্মের বৈশিষ্ট্যের দ্বারা নির্ধারিত হয়, কর্মের ফলাফলের দ্বারা নির্ধারিত হয় না, এবং প্রত্যেকটি কর্মকে তার অন্যান্য সাহায্যকারী বৈশিষ্ট্যের জন্য পৃথক পৃথকভাবে বিচার করা হয় তাকে কর্ম কর্তব্যবাদ বলে।
ই এফ ক্যারিট, এইচ এ প্রিচার্ড, জে বাটলার প্রমুখ কর্ম কর্তব্যবাদের সমর্থক।
নীতি কর্তব্যবাদ কাকে বলে?
নৈতিকতার যে মানদণ্ড বা নীতি অনুসারে বলা হয়, মানুষের কোনো স্বেচ্ছাকৃত কর্মের ন্যায়-অন্যায় বিচার সেই কর্মের নীতির উপর নির্ভর করে, অর্থাৎ কর্মনীতিকে কল্যাণ-অকল্যাণ এবং কিছু মৌলিক কর্মের দ্বারা বিচার করা হয়, সেই মতবাদকে নীতি কর্তব্যবাদ বলা হয়।
স্যামুয়েল ক্লার্ক, রিচার্ড প্রাইস, থমাস রিড- প্রমুখ দার্শনিক এই মতের সমর্থক।
নীতি কর্তব্যবাদের ক্ষেত্রে আনুসৃত নিয়মগুলি কি পারস্পরিকভাবে সংঘাতপূর্ণ?
নীতি কর্তব্যবাদে যে নৈতিক মানদণ্ডের কথা বলা হয়েছে, সেটি এক বা একাধিক নিয়ম দিয়ে গঠিত। তবে যখন অনেকগুলি নিয়মকে একত্রিত করে একটি নিয়মগুচ্ছ তৈরি করা হয় তখন বিশেষ কোনো পরিস্থিতিতে সেই নিয়মগুলির মধ্যে একটি সংঘাতপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি নৈতিক মানদণ্ডটি গঠনের সময়ে পরিস্থিতি বিচারে ব্যতিক্রমের জায়গাটি উল্লেখ করে দেন তাহলে এই নৈতিক নিয়মগুলি প্রথম থেকেই ব্যতিক্রমসাপেক্ষ বলে অভিহিত হয়ে থাকবে এবং নিয়মগুলির মধ্যে পারস্পরিক সংঘাতের দিকটিও মূল্যহীন হয়ে পড়েবে।
নীতিবিজ্ঞানী রসের মতে কর্তব্য কয় প্রকার ও কী কী? রসের মতে কোন্ ধরনের কর্তব্যের মধ্যে নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায়?
রসের মতে কর্তব্যের প্রকার: নীতিবিজ্ঞানী রস দুই প্রকার কর্তব্যের কথা বলেছেন, যথা- বাস্তব কর্তব্য (Actual Duty) এবং আপাত কর্তব্য বা দৃষ্টত কর্তব্য (Primafacie Duty)।
কর্তব্যের মধ্যে নিয়মের ব্যতিক্রম: রস বাস্তব কর্তব্য বলতে বুঝিয়েছেন যে কর্তব্যগুলি বাস্তবের সাথে যথোচিত। অর্থাৎ যে সমস্ত কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়মগুলিকে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে ছাড় দেওয়া সম্ভব হয়। অপরদিকে, দৃষ্টত কর্তব্য বলতে বুঝিয়েছেন যেগুলি প্রথম দৃষ্টিতে কর্তব্য বলে মনে হয়। অর্থাৎ যেসব কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়মগুলিকে সাধারণত এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। রসের মতে, প্রকৃত বা বাস্তব কর্তব্যের প্রতিটি নিয়মের ব্যতিক্রম আছে।
ঐশ্বরিক নির্দেশ তত্ত্ব কাকে বলে?
নিয়ম বা নীতি কর্তব্যবাদের অপর নাম হল ঐশ্বরিক নির্দেশ তত্ত্ব বা ঐশ্বরিক ঐচ্ছিকতাবাদ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, ঈশ্বরের ইচ্ছা দ্বারাই যথার্থ- অযথার্থের পরিমাপ করা যায়। কাজের যথার্থ-অযথার্থতার ক্ষেত্রে ঈশ্বরের নির্দেশ ও নিষেধ ছাড়া আর কোনো কিছুর উপরই নির্ভর করা যায় না।
কান্টের নৈতিক বা নীতি কর্তব্যবাদ কী?
কান্ট তাঁর নীতিতত্ত্বে নীতি কর্তব্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর মতে, কোনো কাজকে উচিত কর্ম বলা যাবে, যদি সেই কাজটির কর্মনীতি স্বতঃমূল্যবান হয় এবং কাজটি এক সর্বজনীন নীতিকে অনুসরণ করে। তাঁর নৈতিক মতবাদ-নিয়ম কর্তব্যবাদের মূল তিনটি ভিত্তি আছে। সেগুলি হল-
শর্তহীন বা নিঃশর্ত অনুজ্ঞা, সদিচ্ছা এবং কর্তব্যের জন্য কর্তব্য।
কান্টের কর্তব্যবাদ কী নামে পরিচিত?
জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্টের কর্তব্যবাদটি নীতি কর্তব্যবাদ (Rule Deontology) নামে খ্যাত। কান্ট নৈতিক মতবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কর্তব্যবাদের নীতি গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর মতবাদে চরম নীতি কর্তব্যের উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে এই চরম নৈতিক নিয়মটি হবে সর্বজনীন এবং নিঃশর্ত আদেশ, যা সকলেই সমানভাবে মানতে বাধ্য। তাই কান্টের কর্তব্যবাদ নীতি কর্তব্যবাদ নামে পরিচিত।
নিঃশর্ত বা শর্তহীন অনুজ্ঞা বলতে কী বোঝো?
নৈতিক মতবাদের ক্ষেত্রে কান্ট নীতি কর্তব্যবাদকে গ্রহণ করেছেন। তাঁর মতে, সদিচ্ছা প্রণোদিত হলে, মানুষ তার বিচক্ষণতা ও বিচারবুধি দ্বারা যে নৈতিক নিয়মকে জানে, সেটি হল নিঃশর্ত আদেশ। এই আদেশ বা অনুজ্ঞাকে নিঃশর্ত বলার কারণ এই নিয়ম কোনো উদ্দেশ্য সাধনের উপায় নয়; এটি বিবেকের আদেশ যা আবেগ ও অনুভূতিশূন্য।
কান্টের নীতিবিজ্ঞানে যে তিনটি নীতিবাক্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি কী কী?অথবা, কান্ট প্রদত্ত নিঃশর্ত অনুজ্ঞা বা আদেশের বয়ানগুলি কী কী?
কান্ট তাঁর ‘নিঃশর্ত অনুজ্ঞার’ বর্ণনা প্রসঙ্গে এই আদেশকে তিনটি নিয়মের বা বয়ানের দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। সেগুলি হল- এমন নীতি মেনে কাজ করো, যে নীতিটি একই সঙ্গে একটি সর্বজনীন নীতিতে পরিণত হয়। এমনভাবে কাজ করো যাতে মানবসত্তা কখনোই নিছক উপায় হিসাবে নয়, সর্বদাই উদ্দেশ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। উদ্দেশ্য রাজ্যের একজন বিধিপ্রণয়নকারী রূপে গণ্য হও।
নিঃশর্ত অনুজ্ঞার কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে?
ইমানুয়েল কান্টের মতে নিঃশর্ত অনুজ্ঞা বা আদেশের কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না। কারণ নিঃশর্ত অনুজ্ঞা হল সর্বজনীন আদেশ, যা পালন করতে সকলেই বাধ্য থাকে। এই অনুজ্ঞা এতটাই আবশ্যিক যে এটি ব্যতিক্রমহীনভাবে সকলে পালন করে। কান্টের মতে এই অনুজ্ঞা হল বিবেকের আদেশ।
‘সদিচ্ছা’ বলতে কান্ট কী বুঝিয়েছেন?
কান্টে তাঁর নৈতিক কর্তব্যবাদের আলোচনায় ‘সদিচ্ছা’ (Good Will) শব্দটির প্রয়োগ করেছেন। ‘সদিচ্ছা’ শব্দটির শব্দগত অর্থ হল -সৎ (শুভ) + ইচ্ছা = সদিচ্ছা। কান্টের মতে, যে ইচ্ছাগুলি শর্তহীন ভাবে ও নিজ বৈশিষ্ট্যতে সৎ বা শুভ, তাকেই ‘সদিচ্ছা’ বলা হয়। কান্ট এই ‘সদিচ্ছা’ গুলিকে বিবেকের নির্দেশ অনুসারে সম্পাদিত কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
‘কর্তব্যের জন্য কর্তব্য’ কথাটির অর্থ কী?
কান্ট-এর বিখ্যাত উক্তি হল ‘কর্তব্যের জন্য কর্তব্য’। এই বাক্যের অর্থ হল ফললাভের আশা না করে কোনো উদ্দেশ্য সিদ্ধি এবং কোনো অনুভূতির বশবর্তী না হয়ে শুধুমাত্র কর্তব্যের প্রয়োজনে কোনো কাজ করলেই তা কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করা হবে। কর্তব্যের মধ্যে স্নেহ, মমতা, ভালোবাসার কোনো স্থান থাকতে পারে না। কান্টের মতে দয়ার বশবর্তী হয়ে কোনো মানুষের সেবা করার মধ্যে কোনো নৈতিক আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায় না।
আদেশ কী? নিঃশর্ত আদেশ বলতে কী বোঝায়?
যখন কোনো ব্যক্তি, ব্যক্তি-নিরপেক্ষ নীতিকে কেবল আবশ্যিক বলে গণ্য না করে বাধ্যতামূলক বলে মনে করে, তখন সেই নীতিকে কান্টের মতে, আদেশ বলে। কান্ট নৈতিক নিয়মকে নিঃশর্ত আদেশ বলেছেন। যে আদেশ বিনা শর্তে পালন করতে হবে, তাকে নিঃশর্ত আদেশ বলে। এই আদেশ পালন করা আমাদের কর্তব্য-এটি আমাদের বিবেকের বাণী।
কোন্ কোন্ নৈতিক আদর্শ কর্তব্যমুখী নীতির অন্তর্ভুক্ত? কোন্ কোন্ আদর্শ ফলমুখী বা উদ্দেশ্যমুখী নীতির অন্তর্ভুক্ত?
কর্তব্যমুখী নীতির অন্তর্ভুক্ত আদর্শগুলি হল- রস (Ross) স্বীকৃত নৈতিক মানদণ্ড, কান্টের নীতিতত্ত্ব, ঈশ্বরের আদেশমূলক নীতিতত্ত্ব প্রভৃতি। অপরপক্ষে নৈতিক অহংবাদ বা স্বার্থবাদ, মিল ও বেথামের উপযোগবাদ, সিজউইক-এর যৌক্তিক উপযোগবাদ, পূর্ণতাবাদ ফলমুখী নীতির অন্তর্ভুক্ত।
চুরি করা কান্টের মতে অন্যায় কেন?
কান্ট নৈতিক বিধির পূর্ণ তালিকা প্রণয়ন করেননি। তবে চরম নৈতিক বিধির আকার যেমন হতে পারে তা তিনি কয়েকটি নীতিবাক্যে (Maxims) প্রকাশ করেছেন।
এদের অন্যতম হল সেই নীতি অনুসারে কাজ করা যে নীতি অনুসারে ব্যক্তি কাজ করতে পারে এবং একই সময়ে ব্যক্তির অনুসৃত নীতি সর্বজনীন হোক, এমন ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে।
এই নীতিটির পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, চুরি করা অন্যায়। কারণ যে চুরি করে, অর্থাৎ চোর, সে চায় না যে অপরে তার সম্পত্তি চুরি করুক। অর্থাৎ তার কাজ সর্বজনীন হোক, এমন ইচ্ছা সে করতে পারে না। ব্যতিক্রমহীনতা নৈতিক বিধির বৈশিষ্ট্য। সুতরাং চুরি করা কান্টের তত্ত্বে নীতিসম্মত হতে পারে না।
কান্টের মতে পরম কল্যাণ ও পূর্ণ কল্যাণ-এর পার্থক্য কী?
কান্ট তাঁর নীতি কর্তব্যবাদ আলোচনায় পরম কল্যাণের সাথে পূর্ণ কল্যাণের যে ভেদ তা নির্দেশ করেছেন। তাঁর মতে কর্তব্যের জন্য কর্তব্য সম্পাদনের দ্বারা যে পুণ্য (Virtue) লাভ করা হয় সেটি হল পরম কল্যাণ। অপরদিকে পুণ্য ও সুখের (Happiness) মধ্যে সংগতির জন্য যে কল্যাণ লাভ হয় তা হল পূর্ণকল্যাণ। যদিও পুণ্য ও সুখের মধ্যে কোনো আবশ্যিক সম্বন্ধ থাকে না, তথাপি তাদের মধ্যে সংগতি বিধান করেন নৈতিক মূল্যের নিয়ন্ত্রক হিসেবে ঈশ্বর।
সুতরাং কান্টের মতে কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করা হল পরম কল্যাণ। অপরদিকে, এই পরম কল্যাণের সাথে যখন চরম আনন্দ যুক্ত হয় তখন সেটি হয় পূর্ণ কল্যাণ।
কান্টের মতবাদকে কি নীতি উপযোগবাদ বলা যায়?
কান্টের মতবাদের নাম নীতি কর্তব্যবাদ। নীতি কর্তব্যবাদ নীতি উপযোগবাদ থেকে ভিন্ন। এদের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল নীতি কর্তব্যবাদে কর্মনীতিগুলিকে স্বতঃসত্য বলে মেনে নেওয়া হয় কিন্তু নীতি উপযোগবাদে কর্মের সম্ভাব্য পরিণাম চিন্তা করে কর্মনীতিগুলি নির্ধারিত হয়। নীতি কর্তব্যবাদে কর্মনীতিগুলি কর্মফল নিরপেক্ষ কিন্তু নীতি উপযোগবাদে কর্মনীতিগুলি সম্পূর্ণভাবে ফলাফল নিরপেক্ষ নয়।
উপরোক্ত পার্থক্যগুলির কারণে কান্টের মতবাদকে নীতি উপযোগবাদ বলা যায় না।
‘করা উচিত মানেই করতে পারা- উক্তিটি কার ও এর অর্থ কী?
‘করা উচিত মানেই করতে পারা’-উক্তিটি ইমানুয়েল কান্টের। কান্ট তাঁর নীতি কর্তব্যবাদ আলোচনা প্রসঙ্গে নিঃশর্ত আদেশগুলিকে অবশ্যপালনীয় বলে উল্লেখ করেছেন। তবে নিঃশর্ত আদেশগুলি সবসময় সর্বজনীনভাবে পালন করা সম্ভব কিনা- সে বিষয়ে সংশয় ওঠে। এই সংশয় দূরীকরণের জন্য কান্ট উল্লেখ করেছেন- ‘করা উচিত মানেই করতে পারার স্বাধীনতা আছে’। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রতিটি কর্তব্যের পূর্বস্বীকৃতি হিসেবে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে স্বীকার করতে হয়। ইচ্ছার স্বাধীনতাকে যদি কর্তব্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হয়, তবে নৈতিকতার ক্ষেত্রে উচিত-অনুচিতবোধ অর্থহীন হয়ে যায়।
চীকা লেখো: কৃষ্ণতাবাদের হেঁয়ালি।
কান্টের মতে, নৈতিক জীবন হল চির সংগ্রামের জীবন। এই সংগ্রাম হল জীববৃত্তির সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রাম নৈতিক জীবনের পক্ষে অপরিহার্য। নৈতিক জীবন যতদিন চলবে ততদিন এই সংগ্রাম চলবে। সুতরাং কান্টকে স্বীকার করতে হবে, যেদিন এই সংগ্রাম শেষ হবে সেদিন নৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। একেই কৃচ্ছুতাবাদের হেঁয়ালি বলে। বস্তুত নৈতিক অগ্রগতির ফলে এমন একদিন আসবে যখন মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নৈতিক নিয়ম অনুসরণ করবে। সেই দিন এই সংগ্রামের অবসান ঘটবে।
‘কান্টের মতবাদ শূন্যগর্ভ, নিছক আকারগত মতবাদ’ উক্তিটি বিচার করো।
কান্টের তত্ত্বের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তোলা হয় তাদের মধ্যে এটি অন্যতম অভিযোগ। অভিযোগ করা হয়ে থাকে যে কান্টের শর্তনিরেপেক্ষ আদেশ মানুষের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। বাস্তব পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা কর্তব্য তার নির্দেশ কান্ট প্রণীত বিধি থেকে পাওয়া যায় না। সুতরাং কান্টের মতবাদ শূন্যগর্ভ।
কান্টের তত্ত্বের বিরুদ্ধে উল্লিখিত অভিযোগটি সত্য নয়। কোনো কাজ আমাদের করা উচিত বা অনুচিত, তা বিচার করতে গেলে আমাদের প্রশ্ন হবে যে নীতি অনুসারে কাজটি আমরা করেছি, সেই নীতিটিকে আমাদের পক্ষে সর্বজনীন বিধিরূপে অনুমোদন করা সম্ভব কিনা। যদি যায় তবে কাজটি করা যথোচিত হয়েছে।
কান্টের আদেশ শূন্যগর্ভ নয়। এই আদেশ আমাদের আচরণ সম্পর্কে বাস্তব নির্দেশ দেয়।
বাটলার ও রসের মতে নীতিগর্হিত কর্মের কাছে নৈতিক কর্মের কীভাবে পরাজয় ঘটে?
বাটলার ও রসের মতে বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে দেখা যায় যে সম্পাদিত দুটি কাজের মধ্যে একটি কাজের ক্ষেত্রে সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ সাধন করা সম্ভব হলেও কর্মনীতি অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। কিন্তু অপর একটি কাজের ক্ষেত্রে কর্মনীতিকে সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করা সম্ভব হলেও অপেক্ষাকৃত কম মানুষের কম পরিমাণে কল্যাণ সাধিত হয়ে থাকে। এই সমস্ত ক্ষেত্রে উপযোগিতার দিকটি লক্ষ রেখে যদি প্রথম কাজটি সম্পাদিত করা হয় তাহেল নীতিগর্হিত কাজের কাছে নৈতিক কাজের পরাজয় ঘটে।
আরও পড়ুন | Link |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১ | Click Here |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২ | Click Here |
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |