ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য লেখো (Marks 5)

ছড়া’র বৈশিষ্ট্য: লোকসাহিত্যের ব্যতিক্রমী ধারা ছড়ার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল- 
ছড়া লোকমুখে রচিত ও প্রচলিত এক বিশিষ্ট মৌখিক শিল্প।
ছড়ার সংখ্যা ও রচয়িতার নাম জানা একপ্রকার অসম্ভব। 
ছড়ার চলন গুরুগম্ভীর হয় না, কারণ এগুলি দ্রুত লয়যুক্ত। 
ছড়ার বিষয় হালকা, চটুল ও শ্রুতিমধুর হওয়ায় তা শ্রোতা বা পাঠককে সহজেই স্পর্শ করে। 
ছড়ার বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লৌকিক জীবন থেকে উঠে আসায় তা সহজেই আমাদের মোহিত করে। 
গ্রাম্য পরিবেশের অতিসাধারণ মানুষের মুখে এগুলি রচিত হওয়ায় কখনো-কখনো অর্থসংগতির অভাব দেখা যেতে পারে।

Table of Contents

ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য লেখো

ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য লেখো
ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য লেখো

১। ‘ছড়া’ কী এবং ‘ছড়া’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ লেখো। ‘ছড়া’-র বৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।

ছড়া: বাংলা লোকসাহিত্যের অন্যতম উপাদান হল ছড়া। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় Rhyme (রাইম)। ছড়া হল ছন্দবদ্ধ, আবৃত্তিযোগ্য চরণান্তিক মিলবিশিষ্ট ছোটো পরিসরের লোককবিতা। ছড়া সমগ্রভাবে ব্যক্তি কিংবা সমাজের সচেতন মনের সৃষ্টি নয়, বরং ছড়া হল স্বপ্নদর্শী মনের অনায়াস সৃষ্টি। লোকসাহিত্যের ‘ছড়া’-কে দলগত রচনা বলেই মনে করা হয়।

ছড়া-র ব্যুৎপত্তিগত অর্থ: ‘ছড়া’ শব্দটি দেশজ বলে ধারণা করা হয়। যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘বাঙ্গালা শব্দকোষ’-এ ‘ছড়া’ শব্দটিকে সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দজাত বলে দাবি করে, ‘ছড়া’-র অর্থ করেন-‘সমূহ’, ‘পরম্পরা’।

‘বাঙ্গালা ভাষার অভিধান’-এ জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস বলেছেন, ‘ছটা’ বিশেষ্য, ছন্দে গাঁথা পদ্যকথা; গ্রাম্য কবিতা।

আবার, ইন্দু বিকাশ বসু মহাশয়ের মতে, ‘ছড়া’ সম্ভবত ‘ছন্দ’ শব্দের অপভ্রংশ। ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ছড়া’-র অর্থ নির্ণয় করতে গিয়ে দেখিয়েছেন-সংস্কৃত ছটা > প্রাকৃত ছড়া > ছড়া। অর্থ করেছেন, ‘কোন বিষয় লইয়া রচিত গ্রাম্য কবিতা।’ রাজশেখর বসুও তাঁর ‘চলন্তিকা’-য় ‘ছটা’ থেকেই ‘ছড়া’ শব্দের ব্যুৎপত্তির দিকে জোর দিযেছেন এবং অর্থ করেছেন-গ্রাম্য কবিতা।

‘ছড়া’র শ্রেণিবিভাগ: বিষয়গত দিক থেকে ছড়ার প্রকারভেদ নিম্নে ছক-আকারে দেখানো হল-

‘ছড়া’র বৈশিষ্ট্য: লোকসাহিত্যের ব্যতিক্রমী ধারা ছড়ার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল- 

  • ছড়া লোকমুখে রচিত ও প্রচলিত এক বিশিষ্ট মৌখিক শিল্প।
  • ছড়ার সংখ্যা ও রচয়িতার নাম জানা একপ্রকার অসম্ভব। 
  • ছড়ার চলন গুরুগম্ভীর হয় না, কারণ এগুলি দ্রুত লয়যুক্ত। 
  • ছড়ার বিষয় হালকা, চটুল ও শ্রুতিমধুর হওয়ায় তা শ্রোতা বা পাঠককে সহজেই স্পর্শ করে। 
  • ছড়ার বিষয়বস্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে লৌকিক জীবন থেকে উঠে আসায় তা সহজেই আমাদের মোহিত করে। 
  • গ্রাম্য পরিবেশের অতিসাধারণ মানুষের মুখে এগুলি রচিত হওয়ায় কখনো-কখনো অর্থসংগতির অভাব দেখা যেতে পারে।

২। ছড়া কাকে বলে? ছড়ার লক্ষণগুলি নির্ণয় করো।

ছড়ার সংজ্ঞা: ‘ছড়া’ বাংলা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দের বিবর্তিত রূপের মধ্য দিয়ে। এর অর্থ ‘পরম্পরা’ শব্দটিকে নির্দেশ করলেও ছড়া হল মূলত গ্রাম্যকবিতা; যা লোকমুখে কথ্যভাষায় রচিত, লৌকিক পরম্পরায় বাহিত এবং অনেকাংশে অন্ত্যমিলযুক্ত ছোটো আকারের পদ্য। ছড়ার কিছু বিশেষ লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়-

  • ছড়া প্রধানত লোকভাষায় রচিত এবং লোকমুখে প্রচলিত।
  • অসংস্কৃত মানস ও উচ্চারণে জাত বলে ছড়ায় অর্থসংগতির অভাব থাকতে পারে।
  • ছড়ায় লৌকিক জীবনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং লোকমুখিতার দ্বৈতভাব লক্ষ করা যায়।
  • সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতানুযায়ী আদিম ছড়াগুলিতে বিভিন্ন অবদমিত ইচ্ছা ও স্বপ্ন প্রতীকের প্রকাশ ঘটে।
  • ছড়ার রচয়িতার নাম অজানা।
  • ছড়া দ্রুত লয়ের হয় বলে তার চলন গম্ভীর নয়।
  • ছড়ার বিষয়বস্তু মুখ্যত হালকা, চটুল, অগভীর।
  • ছড়ার বিষয় শ্রোতা বা পাঠককে সহজে স্পর্শ করে বলে এর গ্রহণযোগ্যতা বেশি।
  • ছড়ার পর্ববিভাগ সম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ দুই-ই হতে পারে। তবে বিষয়ের মাধ্যমে বক্তব্যের স্পষ্ট প্রকাশ ঘটে।
  • লৌকিক জীবনের নানা বিষয় ছড়ার উপজীব্য বলে ছড়ার সারল্য অনিবার্য।
  • ছড়ার বাক্যগুলি কাটা কাটা, সংযোগহীন ও ছোটো হয়।
  • ছড়ার ভাষা ও উচ্চারণ অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়।
  • ছড়ায় নিটোল কাব্যভাব সর্বদা না থাকলেও কখনো-কখনো সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটে।

৩। ছড়ার উৎস কী? এর শ্রেণিবিভাগ করে আলোচনা করো। ২+৩

ছড়া’র উৎস: ছড়া’ শব্দটির মূল উৎস সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দ। এর মূলে দেশজ যে ভাবটি আছে, তা হল ‘পরম্পরা’ বা গ্রাম্য পদ্যরূপ। প্রাত্যহিক গার্হস্থ্য জীবনের ইতি-নেতিকে গ্রাম্য ভাব-ভাষা-ছন্দে বর্ণিত করার বহু প্রাচীন রীতি থেকেই ছড়া উদ্ভূত। লোকমুখে বাহিত হয়ে ছড়া বর্তমানে গ্রাম্যরীতির কবিতায় পরিণত।

শ্রেণিবিভাগ: বিষয়গত দিক থেকে ছড়াকে প্রধানত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়-

শিশুপ্রধান ছড়া: শিশুদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে রচিত এই প্রকার ছড়াগুলি শিশুমনের আনন্দময়তা, বিস্ময়বোধকে কেন্দ্র করেই জীবন্ত ও বর্ণময়। শিশুপ্রধান ছড়াগুলির তিনটি বিভাগ-

  • ঘুমপাড়ানি ছড়া: শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য শৈশবের কল্পনাজগৎকে আশ্রয় করে সহজ-সরল ভাষায় এই ছড়াগুলি রচিত। এই ছড়ার আঙ্গিক এবং চলন যেন শিশুদের অলৌকিক জাদুতে মুগ্ধ করে। যেমন-‘ঘুম পাড়ানি মাসিপিসি/মোদের বাড়ি এসো,’
  • ছেলেভুলানো ছড়া: বিভিন্ন কাজের মধ্যে শিশুদের ভুলিয়ে রাখার জন্য এই ছড়াগুলো রচিত। যেমন- ‘সোনা সোনা ডাক ছাড়ি/সোনা নেইকো বাড়ি,’
  • খেলার ছড়া: ঘরের ভেতরে-বাইরে খেলার সময় শিশুরা যে ছড়া বলে, তাকে বলে খেলা ছড়া। যেমন- ‘আড়ি আড়ি আড়ি/কাল যাব বাড়ি।’

মেয়েলি ছড়া: অবদমিত নারী হৃদয়ের ইচ্ছা, নারী মনস্তত্ত্ব ও নারীদের আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে মেয়েলি ছড়াগুলি রচিত। যেমন-

‘এলাডিং বেলাডিং সইলো,
একটি খবর আইলো।’

৪। উদাহরণ-সহ মেয়েলি ছড়া ও ঘুমপাড়ানি ছড়ার বৈশিষ্ট্য লেখো।

মেয়েলি ছড়ার বৈশিষ্ট্য: মেয়েলি ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • প্রধানত মেয়েদের মুখেই এগুলির সৃষ্টি এবং বিকাশ ঘটে।
  • এখানে নারীহৃদয়ের তীব্র আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়।
  • মেয়েলি ছড়াগুলিতে বিশেষভাবে অপরিণত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়, তবে অনেকক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও লক্ষণীয়।
  • মেয়েদের চিত্তবিনোদন ও খেলাধুলা উপকরণ হিসেবে ছড়াগুলি রচিত হয়। 
  • ছড়াগুলি মেয়েদের মধ্যে খেলাধুলার সঙ্গে সঙ্গে সাংসারিক রীতিরেওয়াজ বজায় রাখা ও পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত রাখার শিক্ষা দেয়। 
  • ছড়াগুলিতে অর্থময়তা স্পষ্ট হয় বটে কিন্তু একই সঙ্গে ভাষাগত অসংলগ্নতাও লক্ষ করা যায়।

উদাহরণ:

“আমপাতা জোড়া জোড়া, মারবো চাবুক চড়ব ঘোড়া, 
ওরে বিবি সরে দাঁড়া, আসছে আমার পাগলা ঘোড়া, 
পাগলা ঘোড়া খেপেছে, বন্দুক ছুঁড়ে মেরেছে, 
অলরাইট ভেরি গুড, মেম খায় চা বিস্কুট”।

‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’র বৈশিষ্ট্য: ‘ঘুমপাড়ানি ছড়া’র বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • এই ছড়াগুলি একান্তভাবেই শিশুকেন্দ্রিক হয়। 
  • ছড়াগুলিতে শিশুর প্রতি মায়ের স্নেহ-মমত্ব গভীরভাবে প্রকাশিত। 
  • এখানে ঘুম পাড়ানোর জন্য নিদ্রাকে আহ্বান করা হয়। ছড়াগুলি মূলত পরিবারের মহিলাদের দ্বারা গীত হয়। 
  • ছড়াগুলি ভীষণ বৈচিত্র্যপূর্ণ হয় না, মূলত একটি বিষয়কেন্দ্রিক হয়। 
  • ছড়াগুলিতে শিশুর ব্যবহৃত বা সেই সংক্রান্ত কিছু বস্তু যেমন- দোলনা, কাজললতা, বিছানা ইত্যাদির চিত্রকল্প ব্যবহৃত হয়।

উদাহরণ: “আয় আয় চাঁদ মামা/ টি দিয়ে যা 
চাঁদের কপালে/ চাঁদ/ টি দিয়ে যা।”

৫। উদাহরণ-সহ ছেলেভুলানো ছড়া’ ও ‘ছেলেখেলার ছড়া’-র বৈশিষ্ট্য লেখো।

অথবা, বাংলা লোকসাহিত্যের ছেলেভুলানো ছড়া’ গুলির বৈশিষ্ট্য সংক্ষেপে আলোচনা করো। 

‘ছেলেভুলানো ছড়া’র বৈশিষ্ট্য: ‘ছেলেভুলানো ছড়া’র উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল- 

  • এই ছড়াগুলির সৃষ্টি ও বিকাশ মূলত মায়ের মুখে হলেও বাড়ির অন্যান্য মহিলাদের মুখেও তা সাবলীলভাবে উচ্চারিত হয়। 
  • শিশুকে শান্ত রাখা বা ভুলিয়ে রাখার জন্য এগুলি ব্যবহৃত হয়। 
  • হাসির ছলে শিশুর মনোরঞ্জনের কাজেও এগুলি ব্যবহৃত হয়। 
  • ছড়াগুলিতে কল্পনার জগৎ বিশেষভাবে উদ্ভাসিত হয়। শিশুর ঘুম, খাদ্যবস্তু, হাসি-কান্না ইত্যাদি বিশেষভাবে এখানে বিরাজ করে। 
  • শিশুকে সোনা, মানিক ইত্যাদি সম্বোধনের মাধ্যমে তার প্রতি গভীর মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়।

উদাহরণ: ” এ দুধ খায় কে রে সোনা মুখ যার রে ঘন দুধের ছানা, সবাই বলে দে না।”

খেলার ছড়ার বৈশিষ্ট্য: ‘খেলার ছড়া’-র উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল- 

  • শিশুদের মুখে এগুলির রচনা ও বিকাশ হওয়ায় ভাষাগত কিছু অসংলগ্নতা লক্ষ করা যায়। 
  • ভাষাগত অসংলগ্নতা থাকলেও ছন্দমিল ও ধ্বনিময়তা উপস্থিত থাকে। 
  • শিশুদের দ্বারা খেলার পরিকল্পনা বা অনেকের মধ্য থেকে কাউকে নির্বাচন করার কৌশল এখানে প্রত্যক্ষ করা যায়। 
  • ছড়াগুলি ঘরের ভিতরের খেলা (Indoor game) ও বাইরের খেলা (Outdoor game)-দুই ধরনেরই হয়ে থাকে। 
  • শিশুদের পারস্পরিক ভাববিনিময়, সৌহার্দ্য স্থাপন বা চতুরতার প্রকাশ ঘটে। 
  • শিশুমনের অহেতুক আনন্দ এবং অসংলগ্ন উদ্দামতার চিত্র ফুটে ওঠে এই ছড়াগুলিতে।

উদাহরণ: “ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি/চামের কাটা মজুমদার/ধেয়ে এল দামোদর।”

৬। ছড়ার উৎস কীভাবে হয়েছিল বলে মনে করা হয়? ছড়ার ছন্দ বিষয়ক সরলতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।

ছড়ার উৎস: ছড়ার সৃষ্টি হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ছড়াকে সমাজের স্বপ্নদর্শী মনে অনায়াসসৃষ্টি বলে মনে করা হয়। ‘ছড়া’ শব্দটির মূল উৎস সংস্কৃত শব্দ ‘ছটা’। এর মূলে দেশজ যে ভাবটি আছে, তা হল ‘পরম্পরা’ বা গ্রাম্য পদ্যরূপ। প্রাত্যহিক গার্হস্থ্য জীবনের ইতি-নেতিকে গ্রাম্য ভাব- ভাষা-ছন্দে বর্ণিত করা বহু প্রাচীন রীতি থেকেই ছড়া উদ্ভূত এবং লোকমুখে বাহিত হতে হতেই ছড়াগুলির বর্তমান রূপটি প্রচলিত বলে মনে করা হয়।

ছড়ার ছন্দের সারল্য: সামান্য অসংলগ্নতা ছড়ার একটি অনিবার্য শর্ত। সমস্ত সংস্কৃতিতে ছড়ার মূল প্রকরণ সাধারণত দুই ধরনের ছেলেভুলানো ছড়া, সর্বজনীন ছড়া। ছেলেভুলানো ছড়ার ক্ষেত্রে অসংলগ্নতা বিষয়ক অনিবার্য শর্তটি সামগ্রিক বললেও অত্যুক্তি হয় না। সর্বজনীন ছড়ার ক্ষেত্রেও অসংলগ্নতা না থাকলে ছড়ার প্রত্যাশিত রসটি যেন আস্বাদিত হয় না। নিজস্ব একটি ছন্দের স্পন্দনই হল ছড়ার সেই রস নিবেদনের বিশেষ মাধ্যম। আর সেই ছন্দই ছড়াকে সর্বজনপ্রিয় মৌখিক শিল্পে পরিণত করেছে। একটু গভীরভাবে দেখলেই দেখা যায় যে, শিশুরা ভালোভাবে কথা বলতে বা বুঝতে না পারলেও ছড়ার ব্যাপারটি তারা সহজেই আয়ত্ত করতে শিখে গিয়েছে। আসলে এর মূলেও রয়েছে ওই স্পন্দিত ছন্দের দোলা।

৭। লৌকিক ছড়া কাকে বলে? একটি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক ছড়ার উদাহরণ দাও।

লৌকিক ছড়া: লোকজীবনকে কেন্দ্র করে, স্বল্প শিক্ষিত, সরল গ্রামীণ জনসাধারণের দ্বারা মৌখিকভাবে সৃষ্ট, ছন্দময়, সংক্ষিপ্তাকার, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ্য-কে লৌকিক ছড়া বলা যায়। লৌকিক ছড়া লোক ও লোকসমাজের স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টি। এটি আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় প্রকারেরই হয়।

আনুষ্ঠানিক ছড়া: বিভিন্ন লোকাচার, ব্রত, পুজোকে মনোগ্রাহী করে তুলতে এবং সেই আচারগুলির নেপথ্যের নানা গল্পকে তুলে ধরতে ছন্দময়রূপে পরিবেশিত হয় আনুষ্ঠানিক লৌকিক ছড়া। যেমন- ‘পুণ্যিপুকুর’ ব্রতের অতিজনপ্রিয় ছড়াটি হল-

“পুণ্যিপুকুর পুষ্পমালা, কে পূজে রে দুপুর বেলা? 
আমি সতী শীলাবতী, সাতভায়ের বোন ভাগ্যবতী- 
দোলায় আসি দোলায় যাই, জনম ভ’রে সিদুর পাই। 
স্বামীর কোলে পুত্রের কোলে মরণ যেন হয় এক গঙ্গা জলে।।”

অনানুষ্ঠানিক ছড়া: কোনো আনুষ্ঠানিক উপলক্ষ্য ছাড়া, ব্যবহারিক প্রয়োগের স্বার্থেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে রচিত ও প্রচলিত হয়। এইসকল ছড়ায় লোকজীবনের নানা উপকরণ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। যেমন-শিশুর সঙ্গে কৌতুক করে প্রচলিত ব্যঙ্গময় ছড়া- 

“কি! নাকের ঘি!
নাক শুকালে খাবি কী!”

শিশুকে আদর করে বহু ছড়া প্রচলিত আছে- “দিদির মাথায় লটকা চুল কোথায় পাবো গাঁদাফুল? 

গাঁদা ফুলের ছড়াছড়ি, আয় গাঁদাফুল আমার বাড়ি- 
বসতে দেব লাল মাদুরি
খেতে দেব মিঠে পান, গেয়ে শোনাবো অনেক গান।।”

৮। ছড়ার ভাষাগত বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করে, ছড়ায় সেগুলির প্রয়োগ কীভাবে ঘটেছে, তা দেখাও।

ছড়ার ভাষাগত বৈশিষ্ট্য: ‘পুনরাবৃত্তি’-ই হল ছড়ার মূলকথা। ছড়ার ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যেগুলি গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলি হল ধ্বন্যাত্মক ও অনুকার শব্দ বা শব্দদ্বৈতের ব্যবহার, সহচর-অনুচর-প্রতিচর শব্দের ব্যবহার, সমভাবার্থক শব্দের প্রয়োগ, বিপরীতার্থক শব্দপ্রয়োগ, একই শব্দ, বাক্যাংশের অবিকৃত পুনরাবৃত্তি, Antithesis রচনা ও তার পুনরাবৃত্তি ইত্যাদি।

ছড়ায় শব্দদ্বৈত: ‘পুনরাবৃত্তি’ ছড়ার ধর্ম-তাই একই শব্দ বারংবার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে ছড়ার মধ্যে এক বিশেষ ছন্দময় গতির সৃষ্টি হয়। যেমন-“শিল শিলাটন, শিলে বাটন, শিল অঝর ঝরে।”

(এখানে ‘শিল’ ও ‘ঝর’ দুটিরই অনুকার শব্দরূপে প্রয়োগ ঘটেছে)

“খিড়কি দুয়োর কেটে দেব, ফুড়ৎ ফুড়ৎ যেয়ো”

(‘ফুডুৎ’ শব্দটির দু-বার প্রয়োগ ছড়ার ভাষা তৈরি করে)।

সহচর-অনুচর-প্রতিচর শব্দ: ছড়ায় সহচর শব্দের প্রয়োগ ঘটে।

যেমন- “মায়ে দিল সরু শাঁখা, বাপে দিল শাড়ি” (এখানে ‘মা’ এবং ‘বাপ’ সহচর শব্দ)।

অনুচর শব্দের ব্যবহারও প্রচুর। যেমন- “পায়ে আলতা মুখে পান”। (এখানে পা এবং মুখ মানবদেহেরই দুই অঙ্গ হলেও আলতা এবং পান অনুচর শব্দ)। আবার, ‘দোলায় আসি, দোলায় যাই’ (এখানে ‘আসি’-‘যাই’ দুটি প্রতিচর শব্দ)।

সমভাবার্থক ও বিপরীতার্থক শব্দ: সমভাবার্থক শব্দদ্বয়ের ব্যবহার ছড়ার ভাষাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। যেমন-‘চোখ ঢুলু ঢুল নয়নতারা’ (এখানে চোখ এবং নয়ন দুটিই সমার্থক শব্দ)

আবার, বিপরীতার্থক শব্দের ব্যবহারও ছড়ায় দেখা যায়। যেমন- “কার পেটের সুয়ো, কার পেটের দুয়ো” (এখানে ‘সুয়ো’-‘দুয়ো’ বিপরীতার্থক শব্দ) ছড়ায় Antithesis: ছড়ায় Antithesis -এর অর্থ হল-একই ওজনের বা পরিসরের দুই বাক্য বা বাক্যাংশকে পর পর বিন্যস্ত করে একটি সমতা- সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা। পর পর Antithesis-এর ফলে একটি রূপগত শৃঙ্খলাও তৈরি হয়। যেমন-

“আয় রে বুড়ী কামার বাড়ী: তোকে দেবো হাতাবেড়ী
আয় রে বুড়ী কুমোর বাড়ী: তোকে দেবো হাঁড়িকুড়ী
আয় রে বুড়ী ঢাকা: তোকে দেবো টাকা।”
ইত্যাদি।

আবার, ‘এক’ বা ‘একটি’ শব্দ দ্বারা বাক্যের দুই অর্ধ রচনাও এক প্রকারের Antithesis। যেমন- “এক কন্যে রাঁধেন-বাড়েন, এক কন্যে খান।”

৯। ছড়ার মধ্যে সামাজিক-পারিবারিক জীবনের ছবি সংক্ষেপে চিত্রিত করো।

ভূমিকা: বাংলা লোকসাহিত্যে ছড়া অত্যন্ত সমৃদ্ধ একটি শাখা। আগেই বলা হয়েছে, ছড়াগুলি গ্রাম্য পরিবেশ থেকে উঠে আসা এবং লৌকিক পরম্পরাসমৃদ্ধ। এর ফলে, ছড়ায় সমাজ ও পরিবারের নানা প্রসঙ্গ নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে।

সামাজিক চিত্র: নবাব আলিবর্দি খাঁ-র আমলে ‘বর্গি’ নামক একদল বহিরাগত দস্যু অত্যন্ত নৃশংস এবং ভয়ংকরভাবে বারে বারে বাংলাকে লুণ্ঠন করে একরকম শ্মাশানে পরিণত করে। সেই আতঙ্কের বাতাবরণ প্রতিফলিত হয় প্রচলিত একটি ছড়ায়-

“ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গি এল দেশে, 
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে।”

পারিবারিক চিত্র: বাঙালির গার্হস্থ্য জীবনে, বিবাহক্ষেত্রে কৌলীন্য প্রথা, সতিনসমস্যা এবং অন্যান্য বিষয় স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়-

যেমন-

  • কৌলিন্য প্রথা : “তালগাছ কাটি বেসর গড়ি গৌরী হল ঝি তোর কপালে বুড়ো বর, আমি করব কী?”
  • সতিনসমস্যা: “অশ্বত্থ কেটে বসত করি সতীন কেটে আলতা পড়ি।”

অর্থনৈতিক চিত্র: কৃষিপ্রধান বাংলায় চাষজনিত পরিকল্পনা, উৎকণ্ঠা ছাড়াও নিমজ্জমান অর্থনীতির কথা প্রকাশিত হয়েছে।

যেমন-

“ধান ফুরোল পান ফুরোল এখন উপায় কি আর কটা দিন সবুর করো রসুন বুনেছি।” “আয় ঘুম আয় ঘুম বান্দিপাড়া দিয়ে। 

বাদিদের ছেলে ঘুমোয় জালমুড়ি দিয়ে।।”

রাজনৈতিক চিত্র: রাজনৈতিক ঘটনা নিয়েও ছড়া রচিত হয়েছে।

যেমন-“সা রে গা মা পা ধা নি
বোম ফেলেছে জাপানি
বোমের ভিতর কেউটে সাপ 
ব্রিটিশ বলে বাপ্-রে-বাপ।”

আরও পড়ুনLink
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১Click Here
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২Click Here
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তরClick Here

Leave a Comment