বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে এসে পড়ে ১৮৫২ সালে হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স-এর লেখা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বা ১৮৫৮ সালে টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ অথবা কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ ইত্যাদি রচনার কথা।
উপন্যাসের প্রাথমিক ধারণা প্রশ্ন উত্তর

১। কথাসাহিত্য কী? কথাসাহিত্যের ধারাগুলি কী কী?
কথাসাহিত্য: আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম উৎকৃষ্ট ধারা হল কথাসাহিত্য। ইংরেজিতে একে Fiction বলা হয়ে থাকে। বাস্তবিক কোনো বিষয়কে ভিত্তি করে কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক বা মানুষের কোনো অবস্থাকে কেন্দ্র করে রচিত মূলত কাল্পনিক সাহিত্য হল কথাসাহিত্য। কথাসাহিত্য নিছক কোনো গল্প নয়, এটি তার চেয়ে বৃহত্তর কিছুকে লক্ষ্য করে রচিত হয়। কথাসাহিত্যে সংলাপের বহুল ব্যবহার লক্ষণীয় এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী তা প্লটের পরিবর্তে থিমের উপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করে।
কথাসাহিত্যের ধারা: কথাসাহিত্যের মধ্যে প্রধানত আটটি উপধারা বর্তমান। সেগুলি হল- হরর, রহস্য। অপরাধ, কল্পবিজ্ঞান, বা সায়েন্স ফিকশন, ওয়েস্টার্ন, ফ্যান্টাসি, ঐতিহাসিক, রোমান্স, থ্রিলার। সাসপেন্স। অবশ্য অনেক উপশ্রেণিও রয়েছে। বেশিরভাগ কথাসাহিত্য এই বিভাগগুলির কোনো একটির অন্তর্গত হবে। উপন্যাস ও ছোটোগল্প এই উপশ্রেণিগুলির মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট।
২। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ঘটেছিল কীভাবে? উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করো।
উপন্যাসের উদ্ভব ঘটে যেভাবে: মানুষের গল্প শোনার আগ্রহ সুপ্রাচীন কাল থেকে-এই আগ্রহের ফলেই কাহিনির উদ্ভব। প্রাচীন কালে লোকমুখে বিভিন্ন দেবদেবীর কথা, রাজাদের রাজ্যজয়ের কাহিনি ইত্যাদি প্রচার হত। পরবর্তী সময়ে নিজের চাহিদা অনুসারে মানুষই তা লিপিবদ্ধ করতে শুরু করে। এভাবেই কাব্য, মহাকাব্য ও নাটকের সৃষ্টি। পরবর্তীকালে তা থেকেই উপন্যাসের জন্ম।
উপন্যাসের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ: বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে এসে পড়ে ১৮৫২ সালে হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স-এর লেখা ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ বা ১৮৫৮ সালে টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ অথবা কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ ইত্যাদি রচনার কথা। এগুলিকে অনেকে বাংলা উপন্যাসের উৎস হিসেবে মনে করলেও এগুলিতে মানুষের পূর্ণ জীবনের গভীরতা ও চরিত্রসৃস্টির অনন্যতা ধরা পড়েনি। প্রকৃত অর্থে বাংলা উপন্যাসের সার্থক রূপকার হিসেবে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) থেকে পরপর অনেকগুলি বিচিত্রধর্মী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে বাংলা উপন্যাসের অনবদ্য প্রতিমা গড়ে তুলেছিলেন।
এরপর একে একে বাংলা উপন্যাসের প্রাথমিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে প্রতাপচন্দ্র ঘোষের ‘বঙ্গাধিপ-পরাজয়’, রমেশচন্দ্র দত্তের ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ ও ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’; হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘বেনের মেয়ে’, ‘কাঞ্চনমালা’; স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘মিবাররাজ’ ও ‘বিদ্রোহ’; মীর মশারফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ প্রভৃতির নাম করতেই হয়। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’-র নামও উল্লেখযোগ্য। তবে এঁদের ধারা পেরিয়ে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের লেখনীর স্পর্শে ধন্য হয়ে বাংলা উপন্যাস আজ পর্যন্ত অসংখ্য প্রতিভাবান লেখকের ধারা বেয়ে তার ক্রমবিকাশের গতিকে অব্যাহত রেখেছে।
৩। উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য কী কী? কোন্ রচনাকে, কেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়?
উপন্যাসের মূল বৈশিষ্ট্য: উপন্যাসের গঠন কেমন হবে তা নিয়ে বিশিষ্টজনের নানারকম মতামত আছে। উপন্যাস গঠনের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
- উপন্যাস মূলত মানবজীবননির্ভর। মানবচরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চরিত্রের মধ্যে বিবর্তন ফুটিয়ে তোলেন প্রাবন্ধিক।
- উপন্যাসের ভিত্তি একটি দীর্ঘ কাহিনি ও সুপরিকল্পিত প্লট। প্লটের মধ্যে ঘটনা ও চরিত্রের ক্রিয়াকাণ্ডকে সুবিন্যস্তভাবে আকর্ষণীয় ও বাস্তবোচিত করে তোলেন ঔপন্যাসিক।
- উপন্যাসের চরিত্রদের আচরণ, ভাবনা, ক্রিয়াকাণ্ড হয়ে ওঠে কাহিনির মূলভিত্তি। উপন্যাসের চরিত্ররাই ঘটনাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
- স্থান-কাল অনুযায়ী চরিত্রদের মুখের ভাষা বা সংলাপের মাধ্যমে ঔপন্যাসিক চরিত্রদের মনস্তত্ত্বকে প্রকাশ করেন ও উপন্যাসের বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলেন।
- ঔপন্যাসিকের স্টাইল, স্বাতন্ত্র্য, জীবনদর্শন সব কিছুর উপর ভিত্তি করেই উপন্যাস গড়ে ওঠে।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস: প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটিকে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়। এটি ১৮৫৮ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ একটা ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনা। ‘আখ্যানধর্মী বৈশিষ্ট্যের’ জন্য ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই রচনার মাধ্যমে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে, সহজবোধ্য ও বোধগম্য করে সাধুভাষাকে পরিবেশন করা হয়েছিল।
৪। লেখকের নাম ও প্রকাশকাল-সহ প্রথম চলিতভাষায় লেখা বাংলা গদ্যের নাম লেখো। এই রচনার বৈশিষ্ট্য কী সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
প্রথম চলিতভাষায় লেখা বাংলা গদ্য: কালীপ্রসন্ন সিংহের লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ প্রথম চলিতভাষায় লেখা বাংলা গদ্য। এটি ১৮৬১-৬২ সালে সম্পূর্ণ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি মূলত ব্যঙ্গাত্মক বা স্যাটায়ারধর্মী রচনা।
রচনার বিষয়: উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা ও শহরতলির ভণ্ডামি, উচ্ছৃঙ্খলতা, রুচিহীনতা, সমসাময়িক সমাজজীবনের উৎসব-অনুষ্ঠানের বিবরণ ইত্যাদি সমাজজীবনের নানা টুকরো টুকরো নকশা জাতীয় রচনা হল এর মূল বিষয়বস্তু।
‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ রচনার ভাষা ছিল সহজসরল, প্রাঞ্জল। ক্রিয়াপদের ব্যবহার, উচ্চারণরীতি সবেতেই পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল কথ্য বাংলা ভাষার। এ ভাষায় কথ্য ও সাধু ক্রিয়াপদের মিশ্রণ ছিল না। কালীপ্রসন্ন সিংহ বুঝেছিলেন, নব্য আধুনিক কলকাতার অনাচার, ভ্রষ্টতা, বিকৃতিকে আক্রমণ করতে হলে সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলার থেকে সর্বজনীন কথ্যভাষার প্রয়োগ বেশি প্রভাব বিস্তার করবে।
৫। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বে বাংলা উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত রচনাগুলি সম্পর্কে কী জান?
অথবা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পূর্বে বাংলা উপন্যাস রচনার প্রস্তুতিপর্বের ধারাটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
প্রস্তুতিপর্ব: ১৮৫২ সালে হ্যানা ক্যাথেরিন ম্যুলেন্স নামের এক বিদেশিনি বাংলা ভাষা শিক্ষা করে ‘The Last Day of the Week’ নামক এক ইংরেজি আখ্যান অনুসারে রচনা করেন ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’। এটি সাধু বাংলায় লেখা। তবে রচনাটিতে লেখিকার কোনো মুনশিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায় না। ১৮৫৮ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ গ্রন্থটি প্রথম মৌলিক রচনার রূপ লাভ করে। গ্রন্থটির ভাষা অত্যন্ত সহজ ও বোধগম্য। তাঁর অনুসৃত ধারার সার্থক অনুসারী ছিলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর লেখা ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’ গ্রন্থটি চলিতভাষায় লেখা। তাঁর রচনায় শালীনতা, চিত্রময়তা, বাঙালিয়ানা লক্ষ করা যায়। এই সময়পর্বে আরও দুটি উপন্যাসের লক্ষণাক্রান্ত রচনা প্রকাশিত হয়। একটি হল ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ এবং অপরটি হল কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের ‘দূরাকাঙ্ক্ষের বৃথা ভ্রমণ’।
উল্লিখিত গদ্য আখ্যানগুলি বাংলা উপন্যাসের পথ প্রস্তুত করেছিল। তবে সার্থক বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
৬। রোমান্স কী এবং বোমান্সের একটি উদাহরণ দাও। সব বোমান্সই উপন্যাস কিন্তু সব উপন্যাসকে বোমান্স বলা যায় না কেন?
রোমান্স: বাস্তব জীবনের সঙ্গে দূরসম্পর্কিত, কল্পনাশ্রয়ী প্রেম, বীরত্বের সঙ্গে অপরিচিত অতীতকে লেখক পুনরুদ্ধার করতে চান অতিপ্রাকৃত বিশ্বাস আর কবিত্বময় কল্পনার উদ্ভাসে। জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতার ঊর্ধ্বে দীপ্যমান মুহূর্তগুলিকে লেখক এক মায়াময় রহস্যে ধরতে চান। এরূপ উপন্যাসধর্মী রচনাই রোমান্স। যেমন- ‘দুর্গেশনন্দিনী’ একটি রোমান্সের উদাহরণ।
রোমান্স এবং উপন্যাস: উৎপত্তির দিক থেকে দেখলে রোমান্স মধ্যযুগে বিস্তার শুরু করেছিল, উপন্যাস সে তুলনায় একেবারে আধুনিক যুগের ফসল। উপন্যাসের কাহিনি সাধারণত মানবিক জীবনের বিভিন্ন উপাদান থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং উপন্যাসে লেখকের জীবনদর্শন, অনুভূতি ইত্যাদি প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকে।
রোমান্সে উপন্যাসের বহু বৈশিষ্ট্য বজায় থাকলেও রোমান্সের কাহিনি হয় মূলত ইতিহাসনির্ভর। লেখক ইতিহাসের কাহিনির সঙ্গে কল্পনার সংমিশ্রণে রোমান্স রচনা করেন। কখনো-কখনো তা বীরত্বব্যঞ্জক ও অতিরঞ্জিতও হয়। তাই সব রোমান্সকে উপন্যাস বললেও, সব উপন্যাস রোমান্স নয়।
৭। ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে আলোচনা করো।
ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব: ১৯০৩ সালে ‘কুন্তলীন’ পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্প ‘মন্দির’ রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আত্মপ্রকাশ। বিষয়বৈচিত্র্যের নিরিখে শরৎচন্দ্র রচিত উপন্যাসগুলিকে প্রধান কয়েকটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়। যথা-
পারিবারিক উপন্যাস: ‘পণ্ডিতমশাই’, ‘নিষ্কৃতি’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলিতে বাংলার পারিবারিক দ্বন্দ্ব-জটিলতা, নারীমনস্তত্ত্ব ইত্যাদি স্থান পেয়েছে।
দাম্পত্যপ্রেম বিষয়ক উপন্যাস: ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘বিরাজ বৌ’, ‘দেবদাস’, ‘শুভদা’ ইত্যাদি উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে সামাজিক অনুশাসনে দাম্পত্যপ্রেমের ঘনিয়ে ওঠা সমস্যা ও সংকট।
সমাজ-সমালোচনা বিষয়ক উপন্যাস: ‘অরক্ষণীয়া’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘বামুনের মেয়ে’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলি এই পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। গ্রামীণ সমাজজীবনের নানান সমস্যা অর্থাৎ পণপ্রথা, কৌলীন্য প্রথা, ইত্যাদির কুফল এই উপন্যাসসমূহে নির্মমভাবে চিত্রিত হয়েছে।
মধুর প্রেমকাহিনিমূলক উপন্যাস: ‘পরিণীতা’, ‘দত্তা’, ‘দেনা পাওনা’ ইত্যাদি উপন্যাস এই পর্যায়ভুক্ত। প্রেমমূলক উপন্যাস রচনায় শরৎচন্দ্রের স্বভাবদক্ষতাই তাঁকে পাঠকহৃদয়ে চিরভাস্বর করে রেখেছে।
সমাজবহির্ভূত প্রেমের উপন্যাস: ‘চরিত্রহীন’, ‘গৃহদাহ’ প্রভৃতি উপন্যাস এই পর্যায়ের অন্তর্গত। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে গভীর প্রেমের রূপ ধরা পড়েছে এই উপন্যাসগুলিতে।
আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস: চার পর্বে বিন্যস্ত শরৎচন্দ্রের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের মধ্যে এক এবং অদ্বিতীয় হল ‘শ্রীকান্ত’। শ্রীকান্তের জীবনের অভিজ্ঞতা, বিচিত্র বর্ণ, খণ্ড খন্ড বিচিত্র কাহিনির বিন্যাস নিয়ে রচিত এই উপন্যাস।
মতবাদপ্রধান উপন্যাস: পরাধীন ভারতের পটভূমিতে রচিত ‘পথের দাবী’ উপন্যাসে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের ব্যাপ্তির কথাই প্রকাশিত। ‘শেষ প্রশ্ন’ উপন্যাসের কমল হিন্দুসমাজের প্রচলিত প্রথাসর্বস্বতার বিপরীতে তীব্র আন্দোলন করেছে। ‘বিপ্রদাস’ উপন্যাসে ভাবাদর্শের সংঘর্ষ উপস্থাপিত হয়।
উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে সহজ বাস্তবকে ছুঁয়ে যাওয়া, নারীজীবনের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ দৃষ্টি ও গ্রামীণ সমাজের সমস্যাকে রূপায়িত করার মধ্য দিয়েই শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
৮। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসগুলির বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য: বাংলা উপন্যাসে কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির বৈশিষ্ট্য হল- শরৎচন্দ্রের উপন্যাস তাঁর গভীর জীবনদর্শন, মানুষের মর্মবেদনা ও প্রণয়মাধুরীর সমন্বয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। আপন লিখনরীতির গুণে তিনি উপন্যাসের চরিত্রগুলিতে প্রাণসঞ্চার করেছেন।
শরৎচন্দ্রকে তাঁর উপন্যাসগুলিতে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, দেশভক্তির নামে ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়। সমাজের মূঢ় হৃদয়হীনতাকে তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর রচনায়।
যৌথ পরিবারের টানাপোড়েন, সমাজ ও পরিবারে নারীদের অবস্থান এবং তাদের সংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতা শরৎচন্দ্রের উপন্যাসে নিখুঁতভাবে বর্ণিত হয়েছে।
দেশপ্রেম ও অবহেলিত জনগণের প্রতি ভাবনাই তাঁকে চালিত করেছিল উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে। তাঁর রচনায় মানবজীবনের সুখ-দুঃখ ও অন্তরবেদনার সাবলীল চিত্র ফুটে উঠেছে। পল্লিবাংলার দারিদ্র্য, কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ বাঙালি সমাজের প্রতিচ্ছবি ধরা পড়ে তাঁর উপন্যাসে।
চিত্তাকর্ষক, সহজসরল রীতিতে গল্প বলার কারণে তিনি আপামর বাঙালি পাঠকের কাছে সমাদৃত।
তাই উপন্যাসসমূহে মানবমনের আবেগের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে, – আবেগ- উচ্ছ্বাসের প্রতিফলনে এবং সংবেদনশীলতাকে রূপদানের জন্য শরৎচন্দ্র বাংলা সাহিত্যে আজও অনন্য।
৯। উপন্যাসের লিখনশৈলীর দিক থেকে বঙ্কিমের তুলনায় কোন্ অংশে আলাদা হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ- অতি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বঙ্কিমের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লিখনশৈলীর তুলনা: বঙ্কিম পরবর্তী সময়ে উপন্যাসকে জীবনবাস্তবতার এক বিস্তৃততর ও সূক্ষ্মতর ভিত্তিভূমিতে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অসামান্য ভাবকল্পনায় ও মনোবিশ্লেষণী শক্তিতে সমাজ ও ইতিহাসের জটিল বাতাবরণে ব্যক্তির যন্ত্রণা, আবেগ-উৎকণ্ঠা নিভৃত সত্তার বেদনাকে ফুটিয়ে তুললেন তিনি।
ব্যক্তির বন্ধন-অবন্ধনের দ্বন্দ্বময় সমগ্রতাকে উপন্যাসে রূপ দেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্কিম সমকালীন সমাজের তুলনায় উন্মুক্ততর সমাজের একজন মানুষ হিসেবে তিনি মহিলাদের মনস্তত্ত্বকে আরও কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এই শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ দেখালেন, নারীরা পুরুষের কাছে চাইছে শান্তি, সম্মান ও নিরাপত্তা। নারীচরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক গতিপ্রকৃতিকে সুচারুভাবে রচনা করলেন তিনি, যা আমরা দেখি ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে।
তবে তাঁর কোনো কোনো উপন্যাসে দৈবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে অপ্রত্যাশিতভাবে মূল চরিত্রগুলির মিলন ও সংসারী হওয়ার চিত্র দেখানো বা বিধবা নারীদের শেষপর্যন্ত সুখী জীবনে পৌঁছে দিতে না পারার মধ্যে সমাজের নিষিদ্ধতাই মূল ভূমিকায় ছিল।
আরও পড়ুন | Link |
ছুটি গল্পের প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
তেলেনাপোতা আবিষ্কার প্রশ্ন উত্তর | Click Here |
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |