লোকসাহিত্য হল, লোকশ্রুতিরই পরিমার্জিত ও পরিণত রূপ। ‘লোক’-এর মুখে মুখে রচিত, প্রচলিত ও সংরক্ষিত সাহিত্যকেই সাধারণত ‘লোকসাহিত্য’ বলা হয়। এই সাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সৃষ্ট হলেও সমষ্টির দ্বারাই তা পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং যুগের পর যুগ প্রচলিত হতে থাকে।
লোককথা প্রশ্ন ও উত্তর

১। লোক’ এবং ‘ফোক’ কী? লোক বা ফোক-এর বৈশিষ্ট্য নিরূপণ করো।
লোক: ‘লোক’ বলতে নিবিড় সন্নিবিষ্ট, দীর্ঘকালের ঐতিহ্যশালী কোনো জনসমষ্টি-কে বোঝানো হয়। সহজভাবে বলতে গেলে, যারা ভীষণভাবে ঐতিহ্যমুখী, গ্রাম-শহরের ভৌগোলিক মানচিত্রকে অতিক্রম করে যারা নাগরিক সভ্যতার তফাতে থেকে, মূলত কৃষি সভ্যতার সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছে, যাদের আর্থিক অবস্থাও নাগরিক সভ্যতার মতো সচ্ছল নয়, তাদেরকে ‘লোক’ বলা যেতে পারে। এরা ধর্মে-কর্মে-বিশ্বাসে সমমনোভাবাপন্ন এবং সমষ্টিগত জীবনচর্যায় অভ্যস্ত।
ফোক: লোকসংস্কৃতিতে ‘ফোক’ (folk) শব্দটি বিশিষ্ট জনগোষ্ঠী বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। কার্যত, ‘লোক’-শব্দটিরই ইংরেজি পরিভাষা ‘ফোক’। সমচেতনা, সমজীবনযাপন, সমঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ সংহত সমাজের মানুষই হল ‘ফোক’ (folk) বা ‘লোক’। এরা সাধারণত কৃষিভিত্তিক পল্লিসমাজের অনগ্রসর মানুষ, যারা প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক।
লোক-এর বৈশিষ্ট্য: মূলত সংঘবদ্ধ এবং বিশেষভাবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠী হল ‘ফোক’ বা ‘লোক’। এরা ভৌগোলিক সীমানার ঊর্ধ্বে উঠে নাগরিক সভ্যতার তফাতে অবস্থান করে এবং অন্য জনসমাজ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করে।
সাধারণত, ভূমিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষেরাই এই সংহত জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এদের প্রাত্যহিক জীবন কঠোর সংগ্রাম দ্বারা আবৃত এবং স্বভাবতই এরা শৌখিনতাবর্জিত।
এই ‘লোক’ বা ‘ফোক’-এর অন্তর্গত মানুষেরা নগরজীবন থেকে দূরে পল্লি অঞ্চলে বসবাস করে। এরা জাতপাত, ধর্ম-অর্ধম, ছুৎমার্গ, তিথি-নক্ষত্র, দিন-ক্ষণ-মাস, গোত্র-বর্ণ, সমাজ-সংস্কার, আচার-বিশ্বাস, ন্যায়-অন্যায় বোধ ইত্যাদি নিয়েই সদা বাদ-প্রতিবাদে ব্যস্ত থাকে।
একটি বিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর ‘লোক’ বা ‘ফোক’-এরা সমঐতিহ্যে বিশ্বাসী, সমধর্ম পালনকারী, সমকর্ম ও জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের আদি উৎস ব্রতশিল্প ও ব্রতকথা এদের ধর্মসাধনার অঙ্গ।
‘লোক’ বা ‘ফোক’ যারা, তারা শিক্ষার আলো থেকে প্রায় বঞ্চিত। কোনোরকমে প্রাথমিক শিক্ষাটুকু তারা অর্জন করে। ফলত, আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকেও আজীবন তাদের বঞ্চিত থাকতে হয়।
২। সংস্কৃতি কী ও তা সাধারণভাবে ক’টি ভাগে বিভক্ত? লোকসংস্কৃতির ভাগগুলি ছকাকারে নির্দেশ করো।
‘সংস্কৃতি’: সমাজদেহে বসবাসকারী ঐতিহ্যাশ্রয়ী মানুষের রুচি, অর্জিত জ্ঞান, রীতিনীতি, প্রথা, নৈতিকতা-এইসব কিছু নিয়েই ‘সংস্কৃতি’। একটি জনসমষ্টির মানুষেরা একটিই বিশেষ সংস্কৃতির পালন, অনুসরণ ও অভ্যাস করে। সংস্কৃতি মানুষকে একত্রিত এবং স্বতন্ত্র করে তোলে।
লোকসংস্কৃতির প্রকার: ‘সংস্কৃতি’-র সম্ভাব্য তিনটি প্রকার-
নগরসংস্কৃতি: নগরসভ্যতা এই সংস্কৃতির স্রষ্টা। এটি নগরায়ণের মূল কারণ।
লোকসংস্কৃতি: বৃহত্তম লোকসমাজই লোকসংস্কৃতির স্রষ্টা। ‘লোক’ বা ‘ফোক’-এর জীবনযাপনই এই সংস্কৃতির উপজীব্য।
আদিম সংস্কৃতি: উপজাতি সমাজ এই আদিম সংস্কৃতির স্রষ্টা।
লোকসংস্কৃতির বিভাজন: লোকসংস্কৃতির বস্তুনির্ভর ও অবস্তুনির্ভর দুটি দিককে আরও কয়েকটি ভাগে বিভাজন করা যায়।
৩। লোকসংস্কৃতি কাকে বলে? লোকসংস্কৃতির চরিত্র ও গঠনগত ভাগগুলি নির্দেশ করে, এর কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লেখো।
‘লোকসংস্কৃতি : ‘লোক’ তথা ঐতিহ্যবাহী একটি বিশিষ্ট জনসমষ্টির যৌথ, উৎকৃষ্ট ক্রিয়াকলাপকেই সেই জনসমষ্টির ‘লোকসংস্কৃতি’ বলা হয়। বহুদিন ধরে চলে আসা জীবনচর্যা, লোকায়ত বিশ্বাস, মানসচর্চারই একটি মার্জিত রূপায়ণ হল লোকসংস্কৃতি। দেশজ, লৌকিক, প্রাকৃত উপাদানই লোকসংস্কৃতির মূল। পল্লিজীবনের সংস্কৃতিই লোকসংস্কৃতির উপজীব্য।
লোকসংস্কৃতির ভাগ: চরিত্র ও গঠনপ্রকৃতি অনুসারে লোকসংস্কৃতিকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। লোকসংস্কৃতির ভাগ দুটি হল বস্তুনির্ভর লোকসংস্কৃতি। উদাহরণ: পোশাক-পরিচ্ছদ, লোকশিল্প, লোকভাস্কর্য, লোকাচার ইত্যাদি বস্তুনির্ভর লোকসংস্কৃতির অন্তর্গত। অবস্তুনির্ভর লোকসংস্কৃতি। উদাহরণ: মৌখিক সাহিত্য অর্থাৎ ‘লোক’-এর মুখে মুখে রচিত ও প্রচলিত সাহিত্যই অবস্তুনির্ভর লোকসংস্কৃতির উদাহরণ।
লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য: লোকসংস্কৃতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, সেগুলি হল-লোকসংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে পল্লিজীবন বা গ্রামীণ কৃষিকেন্দ্রিক জীবনকথাই মূলত ধরা পড়ে।
- লোকসংস্কৃতির মাধ্যম হল-মৌখিক।
- লোকসংস্কৃতির স্রষ্টা সংহত সমাজের গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষ। তাই এটি মূলত স্মৃতি ও শ্রুতিনির্ভর এবং বিবর্তনধর্মী।
- লোকসংস্কৃতিজাত সাহিত্য মূলত নিরক্ষর মানুষের সৃষ্টি, তা অলিখিত এবং স্রষ্টার নামবিহীন।
- লোকসংস্কৃতি ঐতিহ্যনির্ভর, সরল ও অকৃত্রিম।
৪। লোকসংস্কৃতি ও অভিজাত সংস্কৃতি কাকে বলে? এই দুই সংস্কৃতির সাধারণ কয়েকটি পার্থক্য নির্দেশ করো।
লোকসংস্কৃতি: ‘লোক’ তথা ঐতিহ্যবাহী একটি বিশিষ্ট জনসমষ্টির যৌথ, উৎকৃষ্ট ক্রিয়াকলাপকেই সেই জনসমষ্টির ‘লোকসংস্কৃতি’ বলা হয়। বহুদিন ধরে চলে আসা জীবনচর্যা, লোকায়ত বিশ্বাস, মানসচর্চারই একটি মার্জিত রূপায়ণ হল লোকসংস্কৃতি। দেশজ, লৌকিক, প্রাকৃত উপাদানই লোকসংস্কৃতির মূল। পল্লিজীবনের সংস্কৃতিই লোকসংস্কৃতির উপজীব্য।
অভিজাত সংস্কৃতি: সমাজের উচ্চসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনচর্যার চিত্র নিয়ে তৈরি যে সাহিত্য, তাকেই পরিশীলিত বা অভিজাত সাহিত্য বলা হয়। উচ্চসম্প্রদায়ের মানুষই এর স্রষ্টা। এটি মূলত লিখিত সাহিত্য এবং এই ধরনের সাহিত্য মার্জিত ও সূক্ষ্ম মননের পরিচয় বহন করে।
৫। বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলির প্রয়োেগ নির্দেশ করে, এর প্রকারভেদ আলোচনা করো।
বস্তুকেন্দ্রিক উপাদান: লোকসমাজের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত উপাদান, যেগুলির মাধ্যমে একটি বিশেষ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মানুষেরা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মিটিয়ে থাকে-সেগুলিকেই লোকসংস্কৃতির বস্তুকেন্দ্রিক উপাদান বলা হয়। বাড়ি, ঘর, খাদ্য, পানীয়, পোশাক-পরিচ্ছদ, কৃষিসরঞ্জাম, আসবাবপত্র, যানবাহন, বাদ্যযন্ত্র প্রভৃতি সব কিছুই লোকসংস্কৃতির বস্তুকেন্দ্রিক উপাদানের অন্তর্গত।
প্রয়োগ: আর্থিক দিক দিয়ে হীনবল ‘লোক’-এরা বিভিন্ন সময় ঢেপ (জলাশয় থেকে উৎপন্ন এক ধরনের ফল), নালগাছ, শাকসেদ্ধ, ভুট্টা প্রভৃতি সহজলভ্য, অল্পমূল্য খাদ্যসামগ্রী খেয়ে খিদে মেটায়।
এমনকি নদীর পাশের লবণাক্ত মাটি থেকে এরা এক বিশেষ পদ্ধতিতে ‘নুন’ও তৈরি করে।
‘লোক’ বা ‘ফোক’-দের পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যেও বিশেষত্ব দেখা যায়। পুরুষেরা ধুতি, গামছা, পাগড়ি পরে। মেয়েদের প্রসাধনীর মধ্যে আলতা, চন্দন, টিপ থাকে। গহনার মূল্য তাদের সামর্থ্যের বাইরে হওয়ায় তারা ফুলের গয়না দিয়ে অঙ্গের শোভা বর্ধন করে।
কৃষিসরঞ্জামরূপে এরা লাঙল, কোদাল, কান্তে ইত্যাদি ব্যবহার করে। গোরু-মোষের গাড়ি, ডিঙিনৌকায় যাতায়াত করে। গৃহে সরঞ্জাম বলতে থাকে চাটাই, মাদুর, পিঁড়ি, তক্তাপোশ, প্রদীপ, কুলো ইত্যাদি।
এ ছাড়াও ‘লোক’সমাজের মানুষজন ঢাক, খঞ্জনি, একতারা, বাঁশি ইত্যাদি লৌকিক বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আমোদ করে। এই নিয়েই তাদের লোকজীবন।
প্রকারভেদ: বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন লোকশিল্প। লোকশিল্পী, প্রথমত তার ব্যক্তিগত নান্দনিক পরিতৃপ্তির প্রয়োজন এবং দ্বিতীয়ত সমাজ ও অর্থনীতির স্বার্থে শিল্পের চাহিদাপূরণের উদ্দেশ্যে লোকশিল্প সৃষ্টি করে। বেত শিল্প, মৃৎশিল্প, মুখোশ শিল্প, ডোকরা শিল্প, পাট শিল্প, নকশিকাঁথা, লাক্ষা শিল্প, বস্ত্র শিল্প, বাঁশ শিল্প, শঙ্খ শিল্প ইত্যাদি হল লোকশিল্পের উদাহরণ।
বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির একটি উপাদান হল লোকখাদ্য। যেমন- পিঠেপুলি, নাড়ু, মুড়ি, পান্তা ইত্যাদি।
শিকারের ক্ষেত্রে তিরধনুক, বর্শা ইত্যাদি লোক অস্ত্রের প্রয়োগ করা হয়।
লোকযান হিসেবে পালকি, নৌকা, ভেলা, ডিঙা ইত্যাদি লোকসমাজের মানুষেরা যাতায়াতের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে।
ধুতি, চাদর, উত্তরীয়, ফতুয়া, শাড়ি ইত্যাদি লোকবস্ত্র পরিধান করে লোকসমাজের মানুষেরা।
নোলক, বালা, তাগা, টিকলি, হার ইত্যাদি লোক আভরণ তারা অঙ্গসৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য পরে থাকে, সেগুলির ধাতব মূল্য যৎসামান্য।
লোকসংগীত পরিবেশনের সময় সঙ্গে বাজে একতারা, মাদল, ঢাকঢোল, ধামসা ইত্যাদি লৌকিক বাদ্যযন্ত্র।
‘লোক’ বা ‘ফোক’-এর দৈনন্দিন কাজকর্মকে সহজ করে তুলতে লাঙল, কাস্তে, ছিপ, খুরপি-র মতো অনেক লোকযন্ত্রের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এইসকল প্রকরণগুলিও বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান।
৬। বাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান ও সেগুলির প্রয়োগ ব্যাখ্যা করো।
বাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি: লোকসংস্কৃতির এই ধারাটি মৌখিক এবং ঐতিহ্যনির্ভর, যা দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। লোকেরা গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজে বাস করা কালীন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজের মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতা লাভ করে, সেই অভিজ্ঞতার বাস্তব এবং সত্য রূপ বাত্ময় হয়ে প্রকাশিত হয়। সেই বাত্ময় প্রকরণগুলিই বাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান।
প্রয়োগ: লোককথা, ছড়া, গীতিকা ইত্যাদি বাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান।
ছড়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিক ছড়া যেমন বিবাহ, ব্রত ইত্যাদি অনুষ্ঠানে উচ্চারিত হয় তেমনই পারিবারিক প্রসঙ্গ, ব্যক্তি প্রসঙ্গেও উচ্চারিত হয়।
আবার, ধাঁধা যেমন লৌকিক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয় তেমনই পারিবারিক, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক এমনকি দেবদেবী চরিত্র এবং ইতর প্রাণী সম্পর্কিত বিষয়েও ধাঁধার প্রয়োগ ঘটে।
বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত আনুষ্ঠানিক গীতিকাগুলি হল-ভাঁজো, করম, টুসু, জারি ইত্যাদি। আবার সারি, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, ভাওয়ালি, চটকা ইত্যাদি হল অনানুষ্ঠানিক গীতিকা। কাহিনিনির্ভর গীতিকাগুলির মধ্যে ময়মনসিংহ গীতিকা, নাথগীতিকাগুলি উল্লেখযোগ্য। এগুলির কাহিনি সুরের একঘেয়েমি খণ্ডন করে শ্রোতার চিত্তবিনোদনের কাজ করে।
বাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির আরেকটি প্রকার-লোককথার রকমভেদও লোকসমাজে প্রচলিত। যেমন-রূপকথা, ব্রতকথা, পুরাকথা ইত্যাদি।
গল্প প্রসঙ্গে, ‘পঞ্চতন্ত্রের গল্প’ লোকসমাজের নানান উপাদান নিয়েই গঠিত একটি বাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপকরণ।
এই ধরনের লোকসংস্কৃতির মধ্যে অনেকগুলির প্রয়োগ এখন নগরজীবনেও করা হচ্ছে।
৭। অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির বিবরণ দাও।
অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি: লোকসমাজের মানুষজন এক বিশেষ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনচর্যার কাহিনি, তাদের লোকায়ত বিশ্বাস, তথা তাদের বক্তব্য বিষয়টিকে উপস্থাপিত করলে- তাকেই অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি বলা হয়। এই লোকসংস্কৃতি বংশপরম্পরায় প্রবহমান, যা সময়ের প্রেক্ষিতে ঐতিহ্যের রূপ পায়।
প্রকার: ‘লোকনৃত্য’ হল সংহত সমাজের ‘ফোক’ বা ‘লোক’ দ্বারা কৃত, স্বতঃস্ফূর্ত নৃত্যের অবারিত প্রকাশ। অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ধারাটি হল-লোকনৃত্য। লোকায়ত সংস্কৃতির একটি মৌলিক উপাদান হল-এই লোকনৃত্য।
ভৌগোলিক পরিবেশে প্রথা, রীতি, আঞ্চলিক কথ্য ভাষার প্রভেদ ও রুচি-রসবোধের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে লোকনৃত্যের কয়েকটি প্রকার নিরূপণ করা যায়। যেমন-ধর্মীয় আচরণযুক্ত নৃত্য-কীর্তন; সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানে কৃত নাচ-ঘাটু, ঝুমুর; লোকাচারের ভিত্তিতে কৃত নাচ- গাজন, গম্ভীরা, ব্রতপালনে করা লোকনৃত্য-ভাদু, করম। এ ছাড়াও-যুদ্ধনৃত্য ঢালিনাচ, কাঠিনাচ ইত্যাদি হল লোকনৃত্যের জনপ্রিয় প্রকার।
লোকভঙ্গিমাও অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। যেমন- হাত নেড়ে কাছে ডাকা, মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলা, চোখ বড়ো করে ভয় দেখানো বা অসন্তোষ প্রকাশ ইত্যাদি। এই ভঙ্গিগুলি লোকসমাজ থেকেই উদ্ভূত হয়ে আমাদের দৈনন্দিন কার্যকলাপের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে।
৮। বিশ্বাস-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান কোগুলি ও তাদের প্রয়োগ উল্লেখ করো।
বিশ্বাসকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি বা লোকসংস্কার: লোকসমাজের জীবনযাত্রা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে দোলায়মান। লোকবিশ্বাস, লোক অনুষ্ঠান, লোকাচার, প্রথা ইত্যাদি সবই এই পর্যায়ের অন্তর্গত। লোকবিশ্বাস বংশ পরম্পরায় প্রবাহিত হতে থাকে। তাই লোকবিশ্বাস যখন আচরণে পরিণত হয়ে প্রত্যহ কার্যকর হয় তখনই তা লোকসংস্কারে পরিণত হয়।
প্রয়োগ: লোকসমাজ, লোকবিশ্বাস দ্বারাই চালিত হয়। যেমন- লোকসমাজের প্রতিনিধি কৃষকেরা বলে, “আমে ধান তেঁতুলে বান”- যেটি লোকবিশ্বাসজাত একটি প্রবাদ। অর্থাৎ কৃষকেরা বিশ্বাস করে, যে বছর আমের ফলন বেশি হয় সে বছর ধানও বেশি হয়। আবার যে বছর তেঁতুল বেশি হয় সে বছর বন্যা হবেই।
লোকবিশ্বাস থেকেই ‘টোটেম’, ‘ট্যাবু’-র জন্ম হয়। যখন কোনো জনজাতি কোনো একটি বিশেষ প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণীবাচক বস্তু থেকে তাদের জনগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে বলে মনে করে তখন সেটি তাদের লোকবিশ্বাস এবং ওই নির্দিষ্ট প্রাণী, বৃক্ষ বা অপ্রাণী সেই জনজাতির টোটেম বলে পরিচিত হয়। আর লোকবিশ্বাস বা টোটেমের ভীতি থেকে জাত বিভিন্ন বিধিনিষেধই হয়ে ওঠে ‘ট্যাবু’।
নবান্ন, গাজন এগুলি লোক-অনুষ্ঠানের অন্তর্গত।
৯। খেলাধূলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলি কী কী ও সেগুলির প্রয়োেগ কোন্ ক্ষেত্রে হয়?
লোকক্রীড়ার উপাদান: খেলাধুলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি তথা লোকক্রীড়া দেশীয়ভাবে উদ্ভূত। প্রধানত পল্লির ‘লোক’-দের উদ্ভাবিত ক্রীড়া, শরীরচর্চা, চিত্তবিনোদন, অবসরযাপন ইত্যাদি কারণে খেলাধুলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির চর্চা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। নারী-পুরুষ তথা আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই লোকক্রীড়ায় অংশগ্রহণ করেন। খেলাধুলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল-আগডুম-বাগডুম, লুকোচুরি, কানামাছি, হাডুডু, ডাংগুলি, বুড়িবসানো, গাজন প্রভৃতি।
প্রয়োগ: লোকসমাজের দৈহিক ও কায়িক পরিশ্রমের অনুষঙ্গে খেলাধুলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতিগুলি যুক্ত এবং দৈহিক, মানসিক বিকাশে বিশেষ সহায়ক। গায়ের জোর আর উপস্থিত বুদ্ধির দ্বারাই তারা খেলায় জয়লাভ করে।
কিছু কিছু লোকক্রীড়া যেমন আনন্দের অনুষঙ্গ টেনে আনে তেমনই কিছু খেলায় শক্তিমত্তার পরিচয় ফুটে ওঠে। যেমন-লাঠিখেলা।
নৌকা বাইচ-এর মতো খেলায় ফুটে ওঠে প্রতিযোগিতার প্রবৃত্তি। এ ছাড়াও, পশুপাখি নিয়ে খেলা দেখিয়ে আমোদ করাও লোকসংস্কৃতিতে প্রচলিত ছিল। যেমন-বাঁদরের খেলা, মোরগের লড়াই ইত্যাদি। বর্তমানে পশুসুরক্ষার দিকটিকে মান্যতা দিয়ে এইসকল খেলাকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
এভাবেই খেলাধুলা লোকসমাজের মানুষের এক বিশেষ অঙ্গ হিসেবে গড়ে উঠেছে।
১০। লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদান ও তাদের প্রয়োগ উল্লেখ করো।
লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি: লোকমানুষের জীবনচর্যায় লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। এই ধরনের লোকসংস্কৃতির মধ্যে বিভিন্ন রকমের আলপনা, দেয়ালচিত্র, মাটির ঘট বা সরা এবং পিঁড়ি বা আসনে অঙ্কিত নানান চিত্র ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত।
প্রয়োগ: লোকসমাজের মানুষেরা বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবে তাদের বাড়ির উঠোন বা মাটির ঘরের দেয়ালকে আলপনা দ্বারা সজ্জিত করে তোলে। তাদের লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উপাদানগুলি ক্ষুদ্র শিল্পের আকারও ধারণ করে। যেমন-পটশিল্প, ছোটো-বড়ো কাপড়ের উপর বিভিন্ন ঘটনা বা কাহিনি বা দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত হলে সেই কাপড়টিকে ‘পট’ বলা হয় আর পটশিল্পীদের বলা হয় পটুয়া। পটচিত্র বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্য, নাগরিক সমাজের অনেকেই ঘর সাজাতে শৌখিন পটচিত্রের ব্যবহার করে।
বিভিন্ন লোকশিল্প মেলায়, লোকচিত্রশিল্পীদের হাতে আঁকা মাটির সরা, ঘট, পেয়ালা ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। এইসকল ক্ষেত্রেই লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটে।
১১। লোকশ্রুতি’ বলতে কী বোঝো? ‘Folklore’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিরূপণ করো।
লোকশ্রুতি: ‘লোকশ্রুতি’-র ইংরেজি প্রতিশব্দ হল- ‘Folklore’l অর্থাৎ, কোনো একটি বিশিষ্ট জনসমষ্টি বা জনজাতির দীর্ঘকালব্যাপী ইতিহাসের প্রচলিত নানান গল্প, কাহিনি, জনশ্রুতি-কেই একত্রিতভাবে ‘লোকশ্রুতি’ বলা হয়ে থাকে। এই ‘লোকশ্রুতি’-র বৈশিষ্ট্য হল পরিবর্তনশীলতা। লোকশ্রুতিগুলি সর্বদাই লোকের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে প্রচারিত হতে থাকে। কোনো একক ব্যক্তি নয়, বরং সমষ্টিই লোকশ্রুতির বাহক।
Folk: ‘Folk’ শব্দটির সর্বজনগৃহীত অর্থ হল-‘লোক’। Lore: ‘Lore’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। প্রাচীন ইংরেজিতে শব্দটি ছিল ‘Lar’, ডাচ ভাষায় ‘Lier’ এবং জার্মান ভাষায় ‘Lewre’। প্রাচীন টিউটোনিক ভাষায় ‘Lore’ -এর অর্থ ছিল জ্ঞানদান বা আহরণ করা। পরবর্তীতে এর অর্থ হয়-প্রাচীন বিশ্বাস বা কাহিনি বা ‘Wisdom of folk’
Folklore: উইলিয়ম জন থম্স প্রথম ‘Folklore’ শব্দটি ব্যবহার করেন তাঁর ‘দ্য এথেনিয়াম’ পত্রিকায় লেখা একটি চিঠিতে। ‘Folklore’ শব্দটি জার্মান ‘Volkskunde’ শব্দটির সম্ভাব্য অনুবাদ বলে মনে করা হয়। কারও মতে, ‘Folklore’ হল লোকশ্রুতি; আবার কারও মতে, লোকসংস্কৃতি বা লোকযান।
১২। লোকসাহিত্য কাকে বলে? লোকসাহিত্যের প্রধান তিনটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
‘লোকসাহিত্য’: লোকসাহিত্য হল, লোকশ্রুতিরই পরিমার্জিত ও পরিণত রূপ। ‘লোক’-এর মুখে মুখে রচিত, প্রচলিত ও সংরক্ষিত সাহিত্যকেই সাধারণত ‘লোকসাহিত্য’ বলা হয়। এই সাহিত্য কোনো ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সৃষ্ট হলেও সমষ্টির দ্বারাই তা পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং যুগের পর যুগ প্রচলিত হতে থাকে। লোকসাহিত্য কথ্যরূপেই সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। তাই পরিবর্তনশীলতাই এই সাহিত্যের ধর্ম, তবে লেখ্যরূপটি মান্যতা পেলে এই পরিবর্তন ব্যাহত হয়- যদিও তাতে লোকসাহিত্যের গুণমান কোনোভাবে হ্রাস পায় না। লোকশ্রুতি বা প্রচলিত কাহিনির লিখিত রূপ উভয়ই লোকসাহিত্যের প্রকরণ।
লোকসাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
নামহীন: লোকসাহিত্যের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য হল যে, এর প্রকরণ গুলি-স্রষ্টার নামহীন, কিছু কিছু কাব্যকবিতায় লেখকের ভণিতা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রচয়িতার নাম জানা যায় না। অর্থাৎ, লোকসংস্কৃতি ও সাহিত্যে স্রষ্টার পরিচয় গৌণ, সৃষ্টিই মুখ্য।
পরিবর্তনশীলতা: লোকসাহিত্যের আত্মপ্রকাশ লিখিতরূপে ঘটে না, মৌখিকভাবেই তা প্রচলিত এবং যুগযুগ ধরে সংরক্ষিত হয়। কথ্যরূপে প্রচলিত হওয়ার কারণে সাহিত্যের ভাষা ও রূপটি পরিবর্তিত হতে হতেই নবরূপ লাভ করে ও প্রচলিত হয়। পরিবর্তনশীলতাই লোকসাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
স্মৃতিনির্ভর : লোকসাহিত্যের প্রচার কার্যত স্মৃতি এবং শ্রুতিনির্ভর। সংহত সমাজের মানুষেরা তাদের শুনে, মনে রাখা লোকসাহিত্যের স্মৃতিবিজড়িত রূপটিই আর-এক জনের কাছে ব্যক্ত করে-সেও সেটা শোনে, স্মৃতিতে রাখে। সংহত সমাজের জনগোষ্ঠীই লোকসাহিত্যের প্রধান ধারক ও বাহক।
১৩। লৌকিক সাহিত্যের স্বরূপটি বিশ্লেষণ করে, এর ভাগগুলি নির্দেশ করো এবং লোকসাহিত্যের উপবর্গগুলি উল্লেখ করো।
লৌকিক সাহিত্যের স্বরূপ: দীর্ঘ ঐতিহ্যশালী কোনো জাতির নিবিড় সন্নিবিষ্ট জীবন-অভিজ্ঞতাপ্রসূত গৌরববোধ, স্বপ্ন ও চেতনা যখন সেই জনসমষ্টি বা তার ব্যক্তিগত কোনো প্রতিভার দ্বারা সৃষ্ট সাহিত্য আঙ্গিকের মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে বিস্তৃতি লাভ করে তখন সেই অনাড়ম্বর সাহিত্য উপকরণকে লৌকিক সাহিত্য বা লোকসাহিত্য বলা যায়।
লোকসাহিত্যের ভাগ: লোকসাহিত্যকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
গদ্যনির্ভর লোকসাহিত্য: লোককথা পদ্যনির্ভর লোকসাহিত্য: ধাঁধা, ছড়া, প্রবাদ, লোকসংগীত ।
গদ্যপদ্যনির্ভর লোকসাহিত্য: লোকনাট্য এবং গীতিকা।
লোকসাহিত্যের উপবর্গ: লোকসাহিত্যের সাধারণ উপবর্গগুলি পৃথিবীর অধিকাংশ জাতির ক্ষেত্রে অনেকটাই এক। এর মুখ্য উপবর্গগুলি হল- কথা বা লোককথা, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ ও প্রবচন।
লোকসাহিত্য কোনো জাতির বৃহত্তর লোকসংস্কৃতির অঙ্গ। একটি জাতির লোকসাহিত্য কখনও ব্যক্তিগত প্রতিভা বা কখনও সমষ্টিগত সংযোজন এবং তাদের সামগ্রিক জীবন অভিজ্ঞতার দ্বারা লব্ধ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এবং নিজস্ব নান্দনিকতার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতপক্ষে, একটা গোটা জাতির জীবনভাবনা লোকসাহিত্যে প্রতিফলিত হয়।
আরও পড়ুন | Link |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১ | Click Here |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২ | Click Here |
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |