একাদশ শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয় সেমিস্টারে বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনায় ৫ নম্বর থাকবে। বিতর্কের আদলে বিতর্কের বিষয় এবং তার পক্ষে বা বিপক্ষে কিছু যুক্তি দেওয়া থাকবে। পরীক্ষার্থীকে প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষের যুক্তিক্রম বিন্যাস করতে হবে। বিতর্কমূলক রচনায় যুক্তি-প্রতিযুক্তি সাজিয়ে মতের পক্ষে বা বিপক্ষে নিজের বক্তব্যকে অল্প কথায় লিখতে হবে।
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ৩

ফেসবুক আশীর্বাদ – প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষে যুক্তিক্রম বিন্যাস করে প্রবন্ধ রচনা করো
মতের পক্ষে: পৃথিবী নিকট হয়েছে। জ্ঞানচর্চায় অভূতপূর্ব অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিগত প্রচারমাধ্যম হওয়ায়, প্রত্যেকেই তার সৃষ্টিকে প্রকাশ করবার আনন্দ লাভ করছেন। সমাজে গতিশীলতা এসেছে। সংবাদমাধ্যমের অপেক্ষা অনেক দ্রুত দেশ ও বিদেশের ব্যক্তিগত ও সমাজগতসংবাদ প্রেরণ করা সম্ভব হয়েছে। দেশ-বিদেশের সমমনা ও সহমর্মী মানুষেরা নিকট হতে পেরেছেন। মানুষকে আর ‘একা’-র অবজ্ঞায় থাকতে হচ্ছে না।
মতের বিপক্ষে: ভুয়ো তথ্য, ভুয়ো তত্ত্বে দেশ আচ্ছন্ন, পৃথিবী পরিব্যাপ্ত হচ্ছে। মানুষের একান্ত ব্যক্তিজীবনকে ‘একা’ রাখার অভ্যাস চলে যাচ্ছে। ফেসবুকের ব্যক্তিবিজ্ঞাপন প্রকাশ্য হয়ে, অন্যের মনে অবসাদ জন্ম দিচ্ছে। প্রমাণহীন নিন্দা, শ্লেষে মানুষ মানুষের প্রতি হিংসার মনোভাব নিয়ে ব্যক্ত হয়ে যাচ্ছেন। পড়াশোনার মনোযোগ নষ্ট হয়ে, সব বিষয়েই অল্প অল্প জানার রীতি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। সমস্ত সময়ে এইদিকে মনোযোগ, স্বাস্থ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারে।
পক্ষে: বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের অবদানকে আমরা কোনোভাবেই স্বীকার করতে পারি না। কোনো সমাজ বা দেশের অগ্রগতির পিছনে বিজ্ঞানের দান কতটা তা আমরা বলে শেষ কতে পারব না। বর্তমান জনজীবনে ফেসবুকও বিজ্ঞানেরই এক অবদানবিশেষ। ফেসবুকের সাহায্যে সারা দুনিয়ার সঙ্গে আমরা যোগাযোগ রাখতে পারি। নতুন বন্ধু খুঁজে পাওয়া, পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা এইসব কিছুর জন্য এক আশ্চর্য মাধ্যম ফেসবুক। যেসব মানুষ অবসাদে ভোগেন ফেসবুকের সাহায্যে সেই অবসাদ তারা কাটিয়ে উঠতে পারে। সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও নানা বিষয়ে জনমত গঠনে ফেসবুক সেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বিনোদনের জন্য একটা অন্যতম মাধ্যম ফেসবুক। এ ছাড়া ফেসবুকে নিজের অভিজ্ঞতা, কোনো বিষয়ে নিজের মতামত আমরা সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি। অনেকে ব্যাবসায়িক প্রয়োজনে ফেসবুককে ব্যবহার করে থাকে। দেশ এবং বিশ্বের খবরকেও ফেসবুকের সাহায্যে সকলের সামনে তুলে ধরেন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সংস্থাগুলি। মজার খবর, ধাঁধা, ছবি থেকে শুরু করে সৃজনশীল ভাবনা, বিভিন্ন ধরনের গান, খেলাধুলার ভিডিয়ো ফুটেজ এই সব কিছুকে ফেসবুকের সাহায্যে দেখে আমরা নিজেদের জীবনে বৈচিত্র্য আনতে পারি। দূরকে নিকট করেছে ফেসবুকে। বর্তমান প্রজন্মের অগ্রগতির পিছনে ফেসবুক একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে। অনেক মানুষের জীবিকার সন্ধানও দিয়েছে ফেসবুক। বর্তমান সময়ে এ কথা আমরা বলতেই পারি ফেসবুক প্রগতির সোপান।
বিপক্ষে: ফেসবুক যতই দূরকে নিকট করুক, যতই পুরো বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসুক না কেন, ফেসবুকের ওপর কখনোই পুরোপুরি আস্থা রাখা যায় না। ফেসবুকের ভালো দিকের পাশাপাশি খারাপ দিকও আছে। ফেসবুকে অনেক সময় অনেকরকম কুরুচিকর ভিডিয়ো কিংবা ছবি আপলোড করেন অনেকে, এগুলি কোনোটিই সুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক নয়। ফেসবুকে অনেক ফেক প্রোফাইলও থাকে। এই ফেক প্রোফাইলের ফলে মানুষটি আসল না নকল সেটাই বোঝা মুশকিল হয়। এ ছাড়া বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ফেসবুকে নিজেদের সারাদিনের অনেকটা সময় কাটায়। ফলে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। আর পড়াশোনারও ক্ষতি হয়। ফেসবুকে দেওয়া ছবি অনেকে সংগ্রহ করে তার অপব্যবহারও করে থাকে। ফেসবুককে কেন্দ্র করে যত দিন যাচ্ছে সাইবার ক্রাইম ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সারাদিন ফেসবুক করার ফলে অনেকের জীবন থেকেই বহুমুখী বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষাজীবনে এক বিরূপ প্রভাব ফেলছে ফেসবুক। ফেসবুক পেজের গোপনীয়তা সবসময় থাকে না। ফলে অনেক সম্পর্ক গড়ার পাশাপাশি অনেক সম্পর্ক ভেঙেও যায়। নানারকম বিরূপ প্রতিক্রয়ার জন্য ফেসবুকের ওপর অন্ধভাবে আস্থাশীল হওয়া কখনোই উচিত নয়। সারাক্ষণ কম্পিউটারে, ফোনে ফেসবুক করার ফল ক্লান্তি, মাথাধরা, অনিদ্রা ও নানারকম দুশ্চিন্তা আজকালকার নবীন প্রজন্মের চিরসঙ্গী হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া ফেসবুকে সবসময় চেনা লোকের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টই নয়, অনেক সময় অচেনা লোকেরও ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে আর সব অচেনা লোক ভালো না-হওয়ায় সেই রিকোয়েস্ট গ্রহণ করলে নানারকম বিপদে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। এসব দিক থেকে এখনও ফেসবুক ব্যবহার ঝুঁকিবহুল, অনেক ক্ষেত্রে বিপজ্জনকও। তাই ফেসবুকের খারাপ দিক বর্জন করে তাকে ভালোভাবে ব্যবহার করলে তবেই সেটা প্রগতির সোপান হয়ে উঠবে।
দূরদর্শন মানবজীবনকে সমস্যা জর্জরিত করে তুলেছে – প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষে যুক্তিক্রম বিন্যাস করে প্রবন্ধ রচনা করো
পক্ষে : দূরদর্শনের অপকারিতা নিয়ে আজ অনেকেই সোচ্চার। এটি মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তুলেছে। নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আকর্ষণে বহু মানুষ এখন অনেকটা সময় দূরদর্শনের সামনে বসে কাটায়। ফলে তাদের নিত্যকর্মে বিঘ্ন ঘটে। এর আকর্ষণে শিক্ষার্থী ভুলে যায় পঠনপাঠনের কথা। মানুষ ভুলতে বসেছে সামাজিক আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয়তা। এর কোনো কোনো অনুষ্ঠানে থাকে নৈতিক অধঃপতনের বীজ। বর্তমান সমাজে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য অনেকেই দূরদর্শনকে দায়ী মনে করেন। তাই বলা যায় দূরদর্শন মানবজীবনে যতই আনন্দের আয়োজন করে থাক, তার কুপ্রভাব কোনো অংশে কম নয়।
বিপক্ষে: “দূরকে করেছে নিকট বন্ধু-দূরদর্শন”। মহাভারতের যুগে মহাজ্ঞানী সঞ্জয় দিব্যদৃষ্টিবলে কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের ঘটনা হস্তিনাপুরের রাজপ্রাসাদ থেকে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়েছিলেন। বোধহয় সেই দিব্যদৃষ্টিরই অধিকারী আজ বিজ্ঞানের আশীর্বাদের ফসল টেলিভিশন-যার অপর নাম দূরদর্শন। কথা ও দৃশ্যের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই ইলেকট্রনিক মাধ্যমটি আজ শহর-গ্রাম সর্বত্র জনপ্রিয়। দূরদর্শনে আমরা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বাদ পাই। এজন্য এটি প্রধান গণমাধ্যম হয়ে উঠেছে। ‘টেলিভিশন’ একটি মিশ্র শব্দ। গ্রিক ‘টেলি’ শব্দের অর্থ ‘দূর’ আর, ইংরেজি ‘ভিশন’ শব্দের অর্থ ‘দৃশ্য’। এই দুইয়ের মিলনে গড়ে উঠেছে ‘টেলিভিশন’-যার অর্থ দূরদর্শন। জন বেয়ার্ড টেলিভিশনের আবিষ্কর্তা।
দূরদর্শনের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা অপরিসীম। এর কারণ হল দূরদর্শনের মাধ্যমে কথা, চিত্র, রং, শব্দ ও গতি একসঙ্গে প্রতিফলিত করা যায়। আসলে এটি হল একইসঙ্গে চোখে দেখার এবং কানে শোনার মাধ্যম। দূরদর্শনের সাহায্যে যে-কোনো অনুষ্ঠানের ‘লাইভ ব্রডকাস্ট’ অথবা কোনো অনুষ্ঠানের সরাসরি রিলে দেখানো সম্ভব। দূরদর্শন অশিক্ষিত ও স্বল্প শিক্ষিত শ্রোতাদের পক্ষে খুব উপকারী। গণপ্রচারের পক্ষে দূরদর্শন খুবই অনুকূল। বই বা সংবাদপত্র একসঙ্গে একাধিক লোক পড়তে পারে না। কিন্তু দূরদর্শন একসঙ্গে অনেকের পক্ষে দেখা সম্ভব। এই কারণে আধুনিক সভ্যতায় দূরদর্শন গুরত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম হয়ে উঠেছে। এটি শুধু বিনোদন নয়, শিক্ষা-সংস্কৃতি-জাতীয় সংহতি বিস্তারে এর ভূমিকা সর্বাধিক। জনসাধারণের মনে যে-মাধ্যমগুলি সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছে, তার মধ্যে দূরদর্শন সর্বাগ্রে।
দূরদর্শন আজ সমাজজীবনের অপরিহার্য মাধ্যম। এটি মূলত বিনোদন মাধ্যম হলেও এর সামাজিক উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। দূরদর্শন বিনোদন জগতে যুগান্তর এনেছে। দূরদর্শন শিক্ষাপ্রসার বিশেষত লোকশিক্ষা প্রসারে, নিরক্ষরতা দূরীকরণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথাবহির্ভূত জ্ঞান-বিদ্যা শিক্ষায় এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ৪ চিকিৎসা-স্বাস্থ্য, আবহাওয়ার সংবাদ, কৃষি-শিল্প বিষয়ে তথ্য ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত সংবাদ ও জ্ঞান দূরদর্শনের মাধ্যমে প্রচারিত হয়। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ-সমাজের সংহতিচেতনা প্রসারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে।
সুপ্রভাব নয়, বর্তমান গণমাধ্যম কুপ্রভাবই বিস্তার করছে – প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষে যুক্তিক্রম বিন্যাস করে প্রবন্ধ রচনা করো
মতের পক্ষে: সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন, ইনটারনেট ইত্যাদির কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন, সংবাদ বা তথ্য পরিবেশনের প্রভাব মারাত্মক।
মতের বিপক্ষে: নানা কুরুচিপূর্ণ বিজ্ঞাপন ও সংবাদকে বাদ দিলে আজও গণমাধ্যম সুপ্রভাব বিস্তারকারী।
পক্ষে: গণমাধ্যম জনসংযোগের বৃহত্তম মাধ্যম। গণমাধ্যম বলতে সংবাদপত্র, বেতার, দূরদর্শন, ইনটারনেট বিজ্ঞাপন ইত্যাদি বোঝায়। কিন্তু এই মাধ্যমগুলি জনমানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সংবাদপত্রে এমন সব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয় যা শিশুমনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে। সংবাদপত্র, দূরদর্শন বা বেতার মাধ্যমে অর্ধসত্য বা অসত্য খবর প্রচারিত হলে তা জনমানসে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা থাকা প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, অনুমান, কল্পনা দিয়ে বা ঘটনাস্থলে না-গিয়ে ফোনে ঘটনা শুনে সংবাদপত্রে সংবাদ ছাপা ঠিক নয়। একটা ছোটো ভুল খবরে সারাদেশে আগুন লেগে যেতে পারে। দৈনিক সংবাদপত্রে এমন অনেক নিম্নমানের সংবাদ ছাপা হয় যা গালগল্প ছাড়া কিছু নয়। প্রথম শ্রেণির সংবাদপত্রে প্রথম পৃষ্ঠায় এখন অনেক সময় রক্তাক্ত বা নিহত মানুষের ছবি বা কুরুচিকর খবর পরিবেশিত হয়। সংবাদপত্রের দায়িত্বের কথা বা রুচির কথা ভাবলে অবাক হতে হয়। দূরদর্শন দেখা এবং শোনার মাধ্যম, সেখানে প্রচারিত খবর ও ছবির মান দেখলে লজ্জায় মুখ ঢাকতে হয়। সপরিবারে দেখার মতো অনুষ্ঠান প্রায় হয় না বললেই চলে। এর প্রভাব ক্রমশ মারাত্মক হয়ে উঠছে।
বিপক্ষে : গণমাধ্যম জনমানসে সুপ্রভাব ফেলবে, এটা প্রত্যাশিত। জনজাগরণে গণমাধ্যমের বিকল্প নেই। বিজ্ঞাপন না-থাকলে পণ্যসামগ্রী সম্পর্কে মানুষ জানবে না। বিজ্ঞাপনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে, বিজ্ঞাপনকে আকর্ষণীয় করে তুলতে বিজ্ঞাপনদাতা কৌশল অবলম্বন করবেনই। চাঁদের কলঙ্ক কখনও চাঁদের সৌন্দর্যের চেয়ে বড়ো নয়। কলঙ্ক আছে বলেই চাঁদ অত সুন্দর। প্রতিটি মাধ্যমে ভালো-মন্দ দিক থাকবে। ভালো-মন্দ ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়। গণমাধ্যমের কুরুচিকর বিজ্ঞাপনের সংজ্ঞা এক-একজনের কাছে এক-একরকম। ফলে বিতর্ক চলতেই থাকে। সর্বাঙ্গসুন্দর কিছু হয় না। ভালো-মন্দ দিক থাকবে। মন্দ না-থাকলে ভালোটা তো বোঝা যাবে না। তাই মন্দকে বাদ দিয়ে ভালোকে গ্রহণ করলে তো বিতর্ক সৃষ্টি হয় না।
ক্লাসরুম’ শিক্ষার পরিপূরক ‘অনলাইন এডুকেশন’ – প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষে যুক্তিক্রম বিন্যাস করে প্রবন্ধ রচনা করো
মতের পক্ষে: দীর্ঘ বিদ্যালয় বিরতিতে ছাত্রছাত্রীদের গৃহবন্দি জীবনের একমাত্র মাধ্যম ‘অনলাইন এডুকেশন’। এই ব্যবস্থার উৎসাহদাতা বা কার্যকারিতার কৃতিত্ব কিছুটা হলেও করোনা পরিস্থিতি। নার্সারি থেকে উচ্চতর শিক্ষা কার্যত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে এই সমান্তরাল শিক্ষাপদ্ধতিতে। শহর তথা উচ্চবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে এই শিক্ষামাধ্যমের উপযোগিতা অপরিসীম।
মতের বিপক্ষে: আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণে এই সমান্তরাল শিক্ষামাধ্যম দেশের গ্রাম্য জীবনের ক্ষেত্রে পরিপূরক নয়। আচার্য বা শিক্ষকের সান্নিধ্য গ্রহণে যে অজ্ঞানের তিমির দূর হয় তার অভাব এই শিক্ষা দূর করতে পারে না। ‘অনলাইন’ শিক্ষামাধ্যমে শিক্ষার মূলশর্ত থেকে বিদ্যার্থীরা বঞ্চিত হবে। বিকাশের পথ ও লক্ষ্য পরিপূর্ণতা পাবে না।
পক্ষে: তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির ফলেই ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হয়ে উঠেছে ‘অনলাইন এডুকেশন’। এখন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কল্যাণে ভার্চুয়াল ক্লাসরুম শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীর দূরত্ব মুছে দিতে পেরেছে। এ ছাড়া অনলাইন লেখাপড়ার জন্য ব্যবহৃত অ্যাপগুলিও অনেক আধুনিক। পড়ানোর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় লিখনসামগ্রী যেমন: ব্ল্যাকবোর্ড, অডিয়োভিসুয়াল উপকরণ, অন্যান্য শিখন তথ্য প্রভৃতি সবই এগুলির মাধ্যমে সহজেই ব্যবহার করা যাচ্ছে। ফলে লেখাপড়া ক্লাসরুমের গতেবাঁধা যান্ত্রিকতা কাটিয়ে অনেক মনোগ্রাহী হয়ে ৪ উঠেছে। সারা পৃথিবীর আন্তর্জালে যে বিপুল তথ্য মজুত আছে, প্রয়োজনে সেগুলিকেও কাজে লাগানো হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে যখন লকডাউনের কারণে দীর্ঘকাল ধরে স্কুলকলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়েছিল, তখন অনলাইন এডুকেশনকে পাথেয় করেই সারা পৃথিবী বিদ্যাচর্চার মূলধারাকে অব্যাহত রেখেছিল। তাই অনলাইনের উপযোগিতা নিয়ে মানুষের মনে আজ আর কোনো সংশয় নেই। এ ছাড়া অনলাইন শিক্ষার কারণে দূরত্ব, পরিকাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি সহজেই অতিক্রম করা সম্ভব হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ধকল কম হওয়ায় তারাও মানসিকভাবে সতেজ থাকছে। এ কারণেই করোনা অতিমারির বিধিনিষেধ কাটিয়ে পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসা সত্ত্বেও এখনও বহু জায়গায় অনলাইন শিক্ষার চর্চা বহাল আছে। ক্লাসরুমের সীমিত ঘেরাটোপের বাইরে অনলাইন এডুকেশন যে অনেক স্বাধীন, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং যুগোপযোগী-আজ এ কথা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
বিপক্ষে: জনবহুল দেশ ভারতে আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রধান জীবিকা হল কৃষিকাজ। তাই নাগরিক ভারতের চেয়ে গ্রামীণ ভারতের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি অনেক বেশি। ভারতের গ্রামে এখনও সড়কপথের অভাবে আছে, বিদ্যুৎহীনতার আঁধার আছে এবং আছে স্কুলকলেজের অভাব। ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক গ্রামই আছে, যেখানে ‘ইনটারনেট’ শব্দটিরই জন্ম হয়নি। তাই সেখানে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন বা স্মার্ট টিভির উপস্থিতির কথা কল্পনা করাই অসম্ভব। এ ছাড়া যে দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষকে এখনও প্রতিবছর খরা, বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সঙ্গে দুবেলা দু-মুঠোর সংস্থান করতে নাজেহাল হতে হয়; তাদের কাছে এসব আধুনিক ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বড়োই মহার্ঘ বস্তু। তাই সরকারি সাহায্যে স্মার্টফোনের বিলিব্যবস্থা যদি-বা করা সম্ভব হয়, তাকে নিয়মিত সচল রাখা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অর্থাৎ আর্থসামাজিক বৈষম্যের কারণেই এই সমান্তরাল শিক্ষাপদ্ধতি মুখ থুবড়ে পড়ে। এ ছাড়া এদেশে সর্বত্র গতিশীল ইনটারনেট ব্যবহারের পরিকাঠামো এখনও সফলভাবে গড়ে তোলা যায়নি। তাই গ্রামেগঞ্জে অনলাইন ব্যবস্থা ক্লাসরুমের পরিপূরক হয়ে উঠবে এমনটা ভাবা এখনই উচিত হবে না। অনলাইনকে বিকল্প হিসেবে খাড়া করলে বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থী বঞ্চিত ও অবহেলিত হবে। সর্বজনীন শিক্ষা যেমন তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবে, তেমনি সামগ্রিক বিকাশের পথ ও লক্ষ্য অধরাই থেকে যাবে। শিক্ষা সকলের অধিকারে পর্যবসিত না-হয়ে সমাজের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত অংশের হাতেই কুক্ষিগত থেকে যাবে। ফলে ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থার নিরিখে শ্রেণিকক্ষে আচার্য বা শিক্ষকের সক্রিয় সাহচর্য এবং সান্নিধ্য যেভাবে যুগ যুগ ধরে অজ্ঞানের তিমির দূরীকরণে ফলপ্রসূ ভূমিকা গ্রহণ করে চলেছে, তার অভাব কখনোই অনলাইন শিক্ষা পূরণ করতে পারে না-এ কথা সম্পূর্ণ সত্য।
ইনটারনেট পরিষেবা ছাত্রছাত্রীদের মৌলিকতা বা নিজস্বতাকে খর্ব করছে – প্রতিপক্ষের যুক্তির অসারতা প্রমাণ করে সপক্ষে যুক্তিক্রম বিন্যাস করে প্রবন্ধ রচনা করো
বিতর্কের বিষয়: ইনটারনেট পরিষেবা ছাত্রছাত্রীদের মৌলিকতা বা নিজস্বতাকে খর্ব করছে।
মতের পক্ষে: পড়াশোনা ও লেখালেখির ক্ষেত্রে কোথাও অসুবিধায় পড়লে যথাযথ পরিশ্রম না-করেই চটজলদি ইনটারনেট দেখে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে এবং মাথা-না-খাটিয়ে সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর হয়ে মৌলিকতা তথা নিজস্বতা হারিয়ে ফেলছে এ যুগের ছাত্রছাত্রীরা।
মতের বিপক্ষে: অজানাকে জানার আগ্রহ মিটিয়ে প্রকারান্তরে ইনটারনেট পরিষেবা ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তাদের আরও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলছে।
পক্ষে: প্রয়োগ ও ব্যবহারের বিভিন্নতায় শুভ ফলদায়ী বিজ্ঞান যেমন চরম অশুভ মূর্তি ধারণ করে, তেমনই আধুনিকতম প্রযুক্তি ইনটারনেটেরও অশুভ প্রভাব মারাত্মক আকার নিয়েছে বর্তমান সময়ে। স্বল্পসময়ে চটজলদি যাবতীয় কিছুর সমাধান বর্তমান প্রজন্মকে যন্ত্রনির্ভর করে তুলেছে; ছাত্রছাত্রী কিংবা জ্ঞানপিপাসু মন আর বুদ্ধি-বিবেচনা বা চিন্তাশক্তিকে কাজে লাগায় না; মাথা না-খাটিয়ে সম্পূর্ণ যন্ত্রনির্ভর হয়ে নিজেদের মৌলিক সত্তাকে হারাতে বসেছে তারা। ইমেল, এস এম এস, হোয়াটস অ্যাপ কিংবা ম্যাসেঞ্জারের জন্য চিঠি লেখার দক্ষতা বা প্রবণতা কমে যাচ্ছে। ইনটারনেটের আনুকূল্যে অনলাইনে অতিরিক্ত গেমস খেলার কারণে তরুণ যুবক-যুবতিরা গেমে আসক্ত হয়ে ঘরকুনো হয়েছে; মাঠে দলগত খেলাধুলার মধ্য দিয়ে তার চরিত্রগঠন সুস্থ স্বাভাবিক হচ্ছে না-সামাজিক ও মানসিক দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। এরই বিপরীতে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাত্রাহীন আড্ডা, কুরুচিপূর্ণ বিষয়ের প্রতিচর্চার বিষয়গুলো অধিক হারে বেড়ে যাচ্ছে। ইনটারনেটে বিভিন্ন বিষয়ে বিজ্ঞাপনের নগ্নতা বহুলাংশে খারাপ প্রভাব বিস্তার করছে শিক্ষার্থীদের মনে। নেটওয়ার্কিং যুগে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অধিকাংশই ধৈর্যশক্তি হারিয়ে ফেলছে। কম সময়ে অতিরিক্ত ফললাভের আকাঙ্খায় তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। বাণিজ্য ক্ষেত্রেও ইনটারনেটের প্রয়োগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রতারিত হওয়ার ঘটনাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞাপনের চমকে দ্রব্যাদির গুণগত মান বিচার না-করেই যেমন আমরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে অনলাইনে কেনাকাটা করছি, তেমনই একইভাবে অনলাইন লেনদেনে মিথ্যা প্রলোভনে পড়েও লক্ষ লক্ষ টাকার ক্ষতির মুখও আমরা দেখছি। ইমেল মাধ্যমে লটারি জেতা কিংবা জালিয়াতদের পাঠানো লিংক-এ না-বুঝেই আমরা আমাদের পরিশ্রমের অর্থ লোভের বশবর্তী হয়ে হারিয়ে ফেলছি। অপরাধমূলক কাজকর্মের রমরমা ইনটারনেটের অপার আশীর্বাদে আজকের সমাজে বেড়েই চলেছে। মিথ্যা প্রচার, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক ঘটনা ইনটারনেটের দৌলতে সোশ্যাল মিডিয়ায় যুবসমাজের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছে। ইনটারনেট ব্যবহারের মাত্রা ও অভিমুখ নিজস্ব রুচি অনুযায়ী সঠিক পথে পরিবর্তন করতে না-পারলে এর সুপ্রভাব আমাদের অজান্তেই কুপ্রভাবে পরিবর্তিত হবে।
বিপক্ষে: ইনটারনেট এক বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা, যা সারা পৃথিবী জুড়ে মোডেম, ফোন লাইন বা স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ছোটো ছোটো নেটওয়ার্ক ও বিভিন্ন পার্সোনাল কম্পিউটারের মধ্যে সম্পর্কস্থাপন করে। ইনটারনেট নামক জাদুকাঠির ছোঁয়াতেই বিশ্বের সমগ্র তথ্য, রহস্য, জ্ঞানভাণ্ডার নিমেষে চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
বর্তমান যুগ ব্যস্ততার যুগ। এই ব্যস্ততম যুগে দাঁড়িয়ে প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান। আর এই দ্রুততা এনে দেওয়ার জন্য ইনটারনেটের যথেষ্ট অবদান – আছে। অনলাইনে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে বাজার করা; ট্রেন, বিমান কিংবা সিনেমার টিকিট কাটতে এখন আর মানুষকে ভিড় ঠেলে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতিরক্ষা, ডাক-তার, ট্রেডিং, ব্যাংকিং, বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, প্রশাসনিক কাজকর্ম, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ ও কার্য সম্পাদন, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, পাসপোর্ট, জন্ম পরিচয়পত্র, ইলেকট্রিক বিল জমা, ডাক্তারি পরামর্শ, জরুরিকালীন অবস্থায় অনলাইন পড়াশোনা এমনকি বিবাহের পাত্রপাত্রী নির্বাচন-সমস্ত কিছুই এখন ঘরে বসে করে ফেলা সম্ভব। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা কর্মেও বর্তমানে ইনটারনেটের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ তার মনের যাবতীয় প্রশ্ন, শিক্ষার্থী তার পড়াশোনা ও লেখালেখির সকল ধরনের বাধা কেবলমাত্র ইনটারনেটের সহায়তায় সহজেই উত্তীর্ণ হয়ে যায়। অজানাকে জানার আগ্রহ মিটিয়ে প্রকারান্তরে ইনটারনেট পরিসেবা ছাত্রছাত্রী তথা শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তাদের আরও সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলছে। আধুনিক জীবনে ইনটারনেট তাই মানুষের নিত্যসঙ্গী।
আরও পড়ুন | Link |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ১ | Click Here |
বিতর্কমূলক প্রবন্ধ রচনা পর্ব ২ | Click Here |
বৃদ্ধি ও বিকাশের অর্থ প্রশ্ন উত্তর | Click Here |